• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
  • ||
  • আর্কাইভ

মুজিববর্ষে সেরা করদাতার সম্মাননা গ্রহণ করলেন হাজী মোঃ কাউছ মিয়া

প্রকাশ:  ০৭ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মুজিববর্ষে সেরা করদাতার সম্মাননা গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও চাঁদপুরের কৃতীসন্তান দানবীর হাজী মোঃ কাউছ মিয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে কর প্রদানে সততা, আন্তরিকতা ও স্বপ্রণোদনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে জাতীয় রাজস্ব খাতের গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড সিআইপি মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে।
গত ৫ মার্চ শুক্রবার সকালে রাজধানীর রাজস্ব বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে সেরা করদাতার বিরল সম্মাননা প্রদান করে। হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার হাতে সম্মাননা স্মারক, ক্রেস্ট ও মানপত্র তুলে দেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম। এ সময় বোর্ডের অন্যান্য কর্মকর্তা এবং দেশের সকল পর্যায়ের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এ পুরস্কার সম্পর্কে আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম বলেন, আমরা চেয়েছিলাম মুজিববর্ষে দেশের বিশিষ্ট করদাতাদের সম্মান জানাতে। সেখান থেকেই আমরা একজনকে বেছে নেই। হাজী মোঃ কাউছ মিয়া দীর্ঘদিন ধরে দেশের সর্বোচ্চ করদাতাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি কর দেয়াকে নিজের দায়িত্ববোধ মনে করেন।
মুজিববর্ষের সেরা করদাতা হিসেবে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হাজী মোঃ কাউছ মিয়া বলেন, রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া, আল্লাহ আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন। তিনি বলেন, একাত্তরের সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে ভালোবেসেছিলেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরাপত্তার জন্যে একটি রিভলবার লাইসেন্স প্রদান করেন, যার নং-১৪। ওই সময় দেশের যে পরিস্থিতি ছিলো তখন সেই রিভলবারটি খুবই দরকার ছিলো। বয়সের কারণে সেটি নিজের ইচ্ছায় ২০১৮ সালে বংশাল থানায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জমা দেই।
মুজিব শতবর্ষে এসে এ পুরস্কার তার জন্যে অনেক বড় প্রাপ্তি। তাতে তিনি অনেক খুশি ও আনন্দিত। দেশকে ভালোবেসে দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে নিজ দায়িত্ববোধ থেকে কর দিয়ে আসছেন তিনি।
হাজী মোঃ কাউছ মিয়া তাঁর এই স্বীকৃতির জন্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ডক্টর মশিউর রহমান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রাহমাতুল মুনিমের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
দেশে কত বড় বড় বিত্তশালী, প্রভাবশালী, হাইপ্রোফাইল কর্পোরেট ব্যবসায়ী রয়েছেন, তাদের ভিড় ঠেলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পুরাণ ঢাকার হাকিমপুরী জর্দার ব্যবসায়ী হাজী মোঃ কাউছ মিয়াকে মুজিববর্ষের সেরা করদাতা নির্বাচিত করে।
ক’দিন আগেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছর ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে দেশসেরা করদাতার ১ নাম্বার মনোনীত হয়ে ট্যাক্সকার্ড ও সম্মাননা পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগে এবং পরে এ নিয়ে তিনি ১৮ বার সিআইপি মর্যাদার দেশসেরা করদাতার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অর্জনের রেকর্ড গড়েন। এবার তার সাথে যুক্ত হলো মুজিববর্ষের সেরা করদাতার স্বীকৃতি।
গুলশান-বনানী কিংবা মতিঝিলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার নেই হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার। পুরাণ ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি রোডে হাকিমপুরী জর্দার কারখানার একটি কক্ষই তাঁর ‘চেম্বার’। মৌলভীবাজার থেকে সরু এই গলিপথ ধরে কিছুটা পথ হাঁটলেই তাঁর কারখানা। সেখানেই বসেন তিনি। গুলশান-বনানী, মতিঝিলের ডাকসাইটে ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে পুরাণ ঢাকার ঘুপচি গলির এই ব্যবসায়ীই প্রতি বছর সর্বোচ্চ করদাতা হন। প্রতিবারই শীর্ষ করদাতাদের তালিকায় তাঁর নাম থাকছে সবার উপরে। অবশ্য অন্য শ্রেণির ব্যবসায়ীগণ প্রতিবছর সর্বোচ্চ যে পরিমাণ টাকার কর দেন, কাউছ মিয়ার ধারে-কাছেও নেই তারা।
কাউছ মিয়া ৬১ বছর ধরে কর দিয়ে আসছেন। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দেন তিনি। কেনো কর দেয়া শুরু করলেন, এর ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। ২০১৯ সালে এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, আগে টাকা-পয়সা এখানে-সেখানে রাখতাম। এতে নানা ঝামেলা ও ঝুঁকি থাকতো। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দিয়ে ‘ফ্রি’ হয়ে গেলাম। এরপর সব টাকাপয়সা ব্যাংকে রাখতে শুরু করলাম। হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার করে রাখলাম।
১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন কাউছ মিয়া। তাঁর বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে নামেন। বাবার ইচ্ছা ছিলো ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। অথচ ব্যবসায় মন পড়ে থাকা কাউছ মিয়া ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামায় আর পড়াশোনা এগোয়নি। পুরাণবাজার মধু বাবুর স্কুলে পড়েছেন তিনি। ওই স্কুলের পাশেই তাঁর নানা জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম সাহেবের বাড়ি। কাউছ মিয়া তাঁর বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরাণবাজারে স্টেশনারীর দোকান দেন। ওই সময় দেশের প্রসিদ্ধ এই বাণিজ্যিক এলাকায় তার ৬টি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো। এরপর ধীরে ধীরে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন তিনি। পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এবং তামাকসহ অন্যান্য ব্যবসা শুরু করেন। ৪০ থেকে ৪২ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত (তৎকালীনসহ বিভিন্ন সময়ে)।
একবার হাজী কাউছ মিয়া আমদানির ব্যবসায় নামতে লাইসেন্স নিয়েছিলেন। এ ব্যবসায় কারসাজি না করলে টিকে থাকা মুশকিল, এটা চিন্তা করে আমদানির ব্যবসা আর করেন নি। নদী পথে পণ্য পরিবহনের জন্যে বেশ কিছু কার্গো জাহাজ রয়েছে কাউছ মিয়ার। জাহাজগুলো ছেলেদের নামে দিয়ে দিয়েছেন। তারাই এই ব্যবসা দেখাশোনা করছে।
১৯৩১ সালের ২৬ আগস্ট হাজী মোঃ কাউছ মিয়া চাঁদপুরে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বড় বাবার নাম হাজী মোঃ মুসলিম মিয়া বেপারী, দাদার নাম হাজী মোঃ সবদ আলী মিয়া বেপারী (সবদ হাজী)। পিতার নাম হাজী মোঃ আব্বাস আলী মিয়া বেপারী ও মাতা জমিদার কন্যা মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন। তারা কেউ বেঁচে নেই। তাদের বাড়ির বেশ নামডাক ছিলো। এক নামে হাজী বাড়ি হিসেবে চিনতো সবাই। তাঁর দাদারা ছিলেন ৬ ভাই। তাঁরা পায়ে হেঁটে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন। তখন হজ্বে যেতে সময় লাগতো ৬ মাস, এখন সময় লাগছে ৬ ঘণ্টা।
কাউছ মিয়ার বড়বাবা অর্থাৎ নানার পিতা আজগর দেওয়ান ওরফে হাজী রিয়াজ উদ্দিন দেওয়ান। তিনি ছিলেন সতেরশ’ সালের ত্রিপুরার প্রতাপশালী জমিদার। আজগর দেওয়ানের ৭ ছেলে ও ১ মেয়ে। উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলে-মেয়ে আটজনই ছিলেন জমিদার।
আজগর দেওয়ানের কনিষ্ঠ পুত্র জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম। ১৮৬৫ সালে তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাইটেল পাস করেন।
কাউছ মিয়ার বর্তমান বয়স ৯০ বছর। এখনও তিনি প্রতিদিন ১০/১২ ঘণ্টা ব্যবসা পরিচালনা করেন। ব্যবসায়িক জীবনে তিনি কখনো কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তির নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করেন নি। তাঁর বাপ-দাদারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি। এমনকি পূর্ব পুরুষদের কেউ রাজনীতি করেন নি। এ জন্যে কাউছ মিয়া এবং তাঁর ছেলেরাও কোনো রাজনীতি করেন না।
একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে কাউছ মিয়া সবসময় নিজেকে সমাজ ও মানবসেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাকামী বহু মানুষকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর এক চাচাতো ভাই মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জে শহীদ হন। একজন দানবীর হিসেবে কাউছ মিয়ার রয়েছে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সুনাম এবং পরিচিতি। দেশবাসী তাঁকে একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবেই চিনেন। তিনি তাঁর মরহুম পিতা-মাতার নামে উত্তর তারাবুনিয়ায় আব্বাস আলী উচ্চ বিদ্যালয় এবং চাঁদপুর শহরের স্ট্র্যান্ড রোডে (কবি নজরুল সড়কে) মায়ের নামে ফাতেমা খাতুন মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি চাঁদপুর গুয়াখোলা আবাসিক এলাকায় মদিনা জামে মসজিদ এবং স্ট্র্যান্ড রোডে (বর্তমান কবি নজরুল সড়কে) আল-আমিন স্কুলের পাশে বোগদাদীয়া জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদ দুটির মোতওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমি ১৯৫৮ সাল থেকে কর প্রদান করে আসছি। ১৯৬৭ সালে আমাকে তৎকালীন সরকার ১নং করদাতার সার্টিফিকেট প্রদান করেন। আমি ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসি। তখন থেকে তামাকসহ বিভিন্ন মালামাল কেনাবেচা এবং মালামাল গুদামজাত করে ব্যবসা করছি। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্য মজুত করে ব্যবসা করিনি।
দেশসেরা এই করদাতা আরও জানান, ১৯৮৮ সালে তিনি হাকিমপুরী জর্দা তৈরি এবং বাজারজাত করেন। তখন এটি ছিলো কুটির শিল্প। তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৪/৫ জন শ্রমিক কাজ করতো। সরকার ১৯৯৯ সালের জুন মাসে জর্দার উপর ভ্যাট আরোপ করে। তখন বছরে ট্যাক্স প্রদান করতেন ৩০/৩৫ হাজার টাকা। বর্তমানে সম্পূরক শুল্কসহ ট্যাক্স প্রদান করছেন প্রায় ৮/৯ কোটি টাকা। বর্তমানে জর্দা ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
হাজী মোঃ কাউছ মিয়া বাংলাদেশের শীর্ষ করদাতার সর্বাধিক পুরস্কার লাভ করায় এবং সর্বশেষ মুজিব শতবর্ষের সেরা করদাতার স্বীকৃতি পাওয়ায় চাঁদপুরবাসী গর্ববোধ করছে। তাঁর এই সাফল্যের খবর শুনে মানুষের মুখে মুখে কাউছ মিয়ার নাম বেশ আলোচিত হচ্ছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ এবং সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ফুল ও উপহার নিয়ে গিয়ে, ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে শুভেচ্ছা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন জানানো অব্যাহত রেখেছেন।
মানব সেবার দৃষ্টান্ত
১৯৫৪ সাল থেকে এ যাবৎ ২২ বার দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। দেশের যে প্রান্তেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন, পাহাড় ধস আঘাত হেনেছে এবং সামপ্রতিক সময়ে যখন বৈশি^ক করোনা মহামারি দেখা দেয় তখন সহ প্রতিটি দুর্যোগে তিনি বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ-সাহায্য দিয়েছেন।
১৯৮৮-এর ভয়াবহ বন্যার সময় টানা একমাস, ৯৮-এর বন্যার সময় প্রায় দুই মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে পানিবন্দী মানুষের দোরগোড়ায় রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়ে কাউছ মিয়া দেশ-বিদেশে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ২০২০ সালে মানুষ যখন মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসে দিশেহারা, এ সময়েও প্রায় ৭/৮ কোটি টাকার ত্রাণ সহায়তা দিয়ে মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এভাবেই চব্বিশ বছর বয়স থেকে তিনি ৬৬ বছর যাবৎ মানবসেবা করে যাচ্ছেন।

 

সর্বাধিক পঠিত