• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

আধুনিকতা কি সম্পর্কগুলোকে অনুভূতিহীন করে দিচ্ছে?

প্রকাশ:  ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ০০:৪৭ | আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:০৫
রুনা নাছরীন
প্রিন্ট

আমাদের চারিদিকে প্রতিনিয়ত কত অসঙ্গত ঘটনা ঘটেই চলেছে কিন্তু তাতে আমাদের কারো জীবনপ্রবাহ থেমে নেই, নিয়মের গতিতেই চলছে সব এবং চলবে। তারপরও কিছু কিছু ঘটনা দেখে মনে হয় কিভাবে সম্ভব এই ধরনের কাজ করা, সৃষ্টির সেরা মানব সন্তানদের পক্ষে? সভ্যতা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে তেমনি পাশাপাশি মানুষের মানবিক বোধের অবক্ষয় হচ্ছে এবং সুস্থ চিন্তাশক্তিও লোপ পাচ্ছে। তাই বলে নিজের বাবা মাকে অস্বীকার করা, নিজেদের অসুবিধার জন্য বৃদ্ধ মাকে রাস্তায় ফেলে যাওয়া, নিজেরা ঘরে শুয়ে বৃদ্ধা মাকে গোয়াল ঘরে রাখা, অসুস্থ মাকে কারো তত্ত্বাবধানে না রেখে ঘরে তালা মেরে বাইরে চলে যাওয়া– সন্তান হয়ে বাবা-মার প্রতি এতো অবহেলা ও এতো অবজ্ঞা কিভাবে করা যায়। কিভাবে সম্ভব বাবা-মার সাথে এই ধরনের ব্যবহার করা? বেশি অবাক হয়েছি সেই অভাগা মায়ের দুর্ভাগ্যের কথা শুনে, যার দুই ছেলে পুলিশে আছে এবং এক মেয়ে শিক্ষিকা। হয়তো ভাগ্যের বিড়ম্বনা একেই বলে। 

আজ আমরা যতটুকু সুখ-শান্তি বা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছি, তা আমাদের বাবা-মায়ের জন্যই সম্ভব হয়েছে। শত প্রতিকূলতার মাঝে ছেলেদের পাশাপাশি নিজের অবস্থানটুকু করে নিতে যে মানসিক দৃঢ়তা ও সাহসিকতার অধিকারী হতে হয়, সেটাও উনাদের কাছ থেকে পাওয়া। তাদের দেওয়া সাহস উৎসাহ ও সহযোগিতায় আজ আমরা নিজ নিজ অবস্থানটা কিছুটা হলেও অর্জন করতে পেরেছি বা পারছি। স্বল্প আয়ে ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষাদীক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবার জন্য বাবা-মা কতো যে কষ্ট সহ্য করেন এবং কতকিছু থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করেন, কল্পনা করা যায় না। প্রতিটি বাবা মা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেন সন্তানের প্রয়োজন মেটাতে। হয়তো অপ্রয়োজনীয় কোনকিছু চাইলে তা দিতে দেরি করেন কিন্তু অসুবিধা থাকলেও পড়াশোনার উপকরণগুলো কিনে দিতে কখন কার্পণ্য করেন না।   
 
আগে প্রতিটি পরিবারেই বেশি সন্তান থাকতো, এখনকার মতো এক বা দুইজন না। তারপর  গ্রাম থেকে পড়াশোনা করতে আসা, ডাক্তার দেখাতে আসা এবং বিভিন্ন কাজে আত্মীয় স্বজন কেউ না কেউ বাসায় থাকতো। এখনকার মত বলে কয়ে সময় নিয়ে মেহমান আসতো না। এই বিশাল ধকলটা মা-রাই হাসিমুখে সামলে নিতেন। সংসারের বাড়তি প্রয়োজন ও খরচের যোগান দেবার জন্য অতিরিক্ত কাজ যেমন হাস মুরগী পালা এবং ফলমূল শাকসবজির বাগান করতেন, যা যতেষ্ট কষ্টসাধ্য। তখন জীবন পরিচালনার প্রক্রিয়া বা প্রনালী এতো সহজলভ্য ছিল না। সবকিছুতেই বিজ্ঞানের আশীর্বাদ এতটা ছিল না। বিদ্যুৎ থাকলেও স্থায়িত্ব কম ছিল, যখন তখন চলে যেতো। মফস্বল শহরের প্রতিটি বাড়িতে রান্নাঘর আলাদা বা উঠানের একপাশে থাকতো,যা গ্রামে এখনো দেখা যায়। লাকড়ির চুলায় রান্না করতে হতো। 

গরমের প্রখর তাপ,শীতের তীব্রতা বা বর্ষার ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেই প্রতিদিন তিনবেলা রান্নাবান্না পাশাপাশি মেহমানদারী। কাজের সাহায্যের জন্য লোক থাকলেও প্রধান তদারকি মা-দেরকেই করতে হতো। সংসারের কাজের কি অভাব আছে! অবশ্য একি কাজ এখনকার মাকেও করতে হয় তবে আধুনিক সুযোগ সুবিধার সাথে। বাবা মা কষ্ট করবেন তার সন্তানের জন্য, এটাই স্বাভাবিক। সবাই তাই করেন এবং করবেন। তবে উনারা যে কষ্ট করেছেন সন্তান লালন পালনের জন্য সেই কষ্টের কাছে আমাদের কষ্ট অনেক তুচ্ছ। 

আমার বাবা মাকে দেখতাম সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করতে। ছেলেমেয়েদেরকে ঘুম থেকে তুলে হাঁটতে পাঠাতেন। হেঁটে আসার পর রাতে ভিজিয়ে রাখা কাঁচা ছোলা ও বাদাম হাতে হাতে দিতেন এবং তা খেয়ে সব ভাইবোন পড়তে বসতাম। আর মা রান্নাঘরে সকালের নাস্তার জন্য রুটি ভাজি, স্কুলের টিফিন ও স্কুলে খেয়ে যাবার জন্য ভাত ভর্তা বানাতে ব্যস্ত। একহাতেই সব করতেন। তখনকার মা-রা ফ্রিজের সুবিধা ভোগ করতে পারেননি। আমাদের বাড়ীতে ফুল ফল শাঁকসবজি কোন গাছের অভাব ছিল না। আমরাও সহযোগিতা করতাম তবে সকালে গাছে পানি দেবার কাজটা বাবা একাই করতেন। মসজিদ থেকে এসে চাপকল থেকে বালতিকে বালতি পানি ভরে সব গাছের গোড়ায় দিতেন যা যতেষ্ট পরিশ্রমের কাজ। 

একটা উদাহরণ দেই, আমার মাকে দেখতাম, রান্নার মাঝে মাঝে চুলা থেকে আধপোড়া কাঠ তুলতো তারপর পানি দিয়ে জলন্ত কাঠগুলোকে নিবিয়ে রোঁদে শুকাতে দিত এবং শুকানোর পর বস্তায় তুলে রাখতো। কেন? কয়লার ইস্ত্রিতে ব্যবহারের জন্য। এই কয়লাগুলোতে আগুন ধরাতে যতেষ্ট কসরত করতে হতো এবং ইস্ত্রি গরম রাখার জন্য একটু পর পর কয়লা বদলাতে হতো আর বাঁশের চোঙ্গা দিয়ে বার বার ফুঁ দিতে হতো। বাবার অফিসে যাবার কাপড়, ভাইবোন সবার স্কুলের ড্রেস এই কঠিন কসরতের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হতো, যা বেশীরভাগ সময় মাকে করতে হতো। তারপর এলো লোহার ইস্ত্রি, সেও অনেক ঝক্কির কাজ। আরো অনেক পরে এলো ইলেকট্রিক ইস্ত্রি। এই রকম শত শত কাজের উদাহরণ দেওয়া যায় যা অনেক পরিশ্রমের। তখন বেশিরভাগ মা চাকরি করতেন না কিন্তু একজনের আয় দিয়ে কিভাবে যে সবদিক সামলিয়ে সুষ্ঠুভাবে পুরােমাস চালাতেন, তা অতুলনীয়। এমনকি মাস শেষে কিছু টাকা জমিয়েও রাখতেন এবং সেই জমানো টাকা সংসারের প্রয়োজনে বাবাকে দিতেন। বাবা প্রতিবার সুদে আসলে ফিরত দিবেন বলে লোন হিসেবে টাকাটা নিতো এবং প্রতিবারই ফিরত দিতে ভুলে যেতেন। মাঝে মাঝে এই লেনদেনের আমরা সাক্ষী থাকতাম কিন্তু লাভ হতো না। উনি এমনভাবে ভুলে যাবার অভিনয় করতেন যে শত চেষ্টা করেও উনাকে টাকা নেবার কথা মনে করাতে পারতাম না আমরা। বাবা মেয়েদের খুনশুটি দেখে আম্মা মুচকি মুচকি হাসতেন আর বলতেন, আর কখনো লোন দিব না।  

এখন স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে রোজকার করেও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অবশ্য আধুনিক জীবনধারণের নানা উপকরণ কেনার যতেষ্ট ফাঁদও প্রতি পদে পদে তৈরি। আধুনিক সাজ-সরঞ্জামের পরও আমাদের কাছে জীবনধারন করা বড়ই কষ্টসাধ্য, গুছিয়ে উঠতে পারি না, সবকিছুতেই এলোমেলো। কোনকিছুতেই শান্তি নেই আমাদের, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অস্থিরতায় ভুগছি, দুশ্চিন্তা আমাদের সবসময়ের সাথী। এক দুইজন বাচ্চা নিয়ে হিমশিম আমরা। আর তখন মা-রা এতগুলো সন্তান নিয়ে কিভাবে সবকিছু পেরে উঠতেন? আমাদেরকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করার পেছনে উনাদের জীবনের সব সঞ্চয়, সব শ্রম ও শক্তি ব্যয় করেছেন। যার যার অবস্থান থেকে প্রতিটি বাবা-মাই যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তার সন্তান যেন একটু ভালো থাকতে পারে, তাদের পড়াশোনায় যাতে বিঘ্ন না হয়। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিজেদের ছোট ছোট ইচ্ছাগুলোকে নিজের অজান্তেই গলা টিপে মেরে ফেলেন, নিজেরা বঞ্চিত হন শুধুমাত্র সন্তানকে সামনের দিকে এগিয়ে দেবার জন্য। যার ফলশ্রতিতে আজ আমরা উন্নত জীবনের আনন্দটুকু উপভোগ করতে পারছি কিন্তু তাদেরকে সেই আনন্দে অংশীদার করতে বিভিন্ন রকমের আপত্তি তৈরী হয়ে যায়।

কিন্তু কি করে আমরা ভুলে যাই তাদের করা কষ্টগুলো? এই বয়সকালে তাদের কি এমন চাহিদা থাকতে পারে শুধু একটু মনোযোগ ও স্নেহ ভালোবাসা ছাড়া। যে সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য নিজেদের স্বাদ আহ্লাদ ও সব দুঃখ কষ্টকে তুচ্ছ ভেবেছিলেন, সেই সন্তান কিভাবে পারে বাবা মাকে অবহেলা করতে? বাবা মাকে বোঝা ভেবে কিভাবে পারে নিজের বউ বাচ্চাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে? হয়তো বর্তমানের মোহে মানুষ অতীত ভুলে যায়, ভুলে যায় সময়ের পরিক্রমার কথা কিন্তু সময় কোন কিছুই ভুলে না। সময়ের জবাব সময় হলেই পেয়ে যায় প্রতিটি মানুষ।