• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
  • ||
  • আর্কাইভ

৬ বছরে জমা ৮৪৩ ডেথ রেফারেন্সের নিষ্পত্তি কবে?

প্রকাশ:  ১১ অক্টোবর ২০২১, ১২:৩৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

প্রায় ২১ বছর আগে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৪ আসামির মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ বছরের ২৩ মার্চ রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। পরে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য নথিপত্র (ডেথ রেফারেন্স) পৌঁছায় হাইকোর্টে। কিন্তু মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি এখনো।

শুধু এ আদেশেরই নয়, গত ছয় বছরে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশের এমন ৮৪৩টি ডেথ রেফারেন্স জমা পড়েছে উচ্চ আদালতে। যেখানে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে ১৭৫ জন আসামির ৮২টি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছায়। মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের এই শত শত ফাইল স্তূপাকৃতি ধারণ করলেও গত অর্ধযুগে ঠিক কতটি ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, আদালত সূত্রে এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

গত ৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার ও মুখপাত্র ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৪ আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণার পর রায়সহ নথিপত্র গ্রহণ হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়েছে। নিয়ম অনুসারে পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

দুই দশক আগের ওই মামলার রায়ে ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ বা গুলি করে ১৪ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সংঘটিত গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত দুটি মামলা উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের নেতাদের নিশানা করে ছোড়া গ্রেনেডে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। হত্যা ও বিস্ম্ফোরক দুই মামলায় বিচারিক আদালতে মোট ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। এখন বিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডগুলো অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য হাইকোর্টে বেঞ্চ নির্ধারণের নির্দেশনা চেয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হবে। চলতি বছরেই যেন চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হতে পারে, সে লক্ষ্যে শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যায়।

মামলাটির নিষ্পত্তি বিষয়ে গত আগস্টে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এখন আদালত খুলেছে। আমরা চাইছি, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মামলাটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করতে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে যাতে এ মামলাটি শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা শুনানি করে মামলাটি যাতে শেষ করা যায়- এটিই আমাদের লক্ষ্য।

রাজধানীর কলাবাগানে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যা মামলায় মেজর জিয়াসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়। এ বছরের ৩১ আগস্ট ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় দেন। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল বিকেলে কলাবাগানে কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী সেজে জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা।

আলোচিত এ জোড়া খুনের মামলায় রায় ঘোষণার পর গত ১৪ সেপ্টেম্বর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মুহাম্মদ সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে এ তথ্য জানান।

মূলত বিচারিক আদালতে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ‘ডেথ রেফারেন্স’ হিসেবে পরিচিত। তবে দণ্ডিতরা বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেল আপিল ও আপিলের সুযোগ পান। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কোনো ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হলে রেজিস্ট্রার কার্যালয় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়।

বরগুনায় বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আদালত। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ রায় দেন। রায়ে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে মিন্নিসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। পরে ওই বছরের ৪ অক্টোবর মিন্নিসহ দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছায়।

কোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশের ডেথ রেফারেন্স গ্রহণের পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) প্রস্তুত হলে মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে কোনো কোনো মামলার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা হিসেবে আসা ৮৪৩টি মামলার মধ্যে এবছর এসেছে ৮২টি মামলা। যেখানে আসামির সংখ্যা ১৭৫ জন। এর মধ্যে চলতি বছর এ পর্যন্ত কোনো ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি শুরু হয়নি। নিয়ম অনুসারে পর্যায়ক্রমে মামলাগুলোর শুনানি শুরু হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে মামলাগুলোর শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে ছয় বছরে ৮৪৩টি ডেথ রেফারেন্স মামলা উচ্চ আদালতে জমা হলেও এসব মামলার আসামির সংখ্যা কত এবং কতোগুলো মামলা এই সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে, এর কোনো তথ্য মেলেনি সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে।

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আপিল বিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দায়িত্বে থাকা রেজিস্ট্রার মামলার সংখ্যা কত সেটি জানাতে পারলেও হাইকোর্ট বিভাগে মামলা এবং নিষ্পত্তির সংখ্যাগত কোনো হিসাব আমাদের কাছে ওইভাবে নেই।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, কোর্ট খোলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে এতদিন আদালত সীমিত আকারে চলছিল। ওই সময় অনেক চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি করা যায়নি। এখন যেহেতু আদালত খুলেছে, আমরা পর্যায়ক্রমে হাইকোর্টে আসা ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিলসহ গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত মামলাগুলোর শুনানির উদ্যোগ নেবো।

ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মনির জাগো নিউজকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসার পরে বিচারপ্রার্থী যেসব আসামি আগে আপিল আবেদনগুলো করেছে বা জেল আপিলগুলো (জেল পিটিশন) করছে, সিরিয়ালি সেগুলোর শুনানি আগে হচ্ছে। ডেথ রেফারেন্স, জেল আপিলের বিষয়গুলো বা অন্য যে কোনো মামলার শুনানি কীভাবে পরিচালনা হবে, তা প্রধান বিচারপতির ওপর নির্ভর করে।

তিনি বলেন, নিশ্চয় প্রধান বিচারপতি নরমালি সবার প্রতি বিচার করার জন্যই মামলাগুলো সিরিয়ালি নির্ধারণ করেন। গুরুত্বপূর্ণ হলো, লোকটি আগে কনভিকশন হয়েছে, যে সেলে আছে সে তো আগে থেকেই কষ্ট করে আসেছে। তার পিটিশনটিই আগে শোনা উচিত। আমার মনে হয়, সে চিন্তা করেই তিনি (প্রধান বিচারপতি) ডেথ রেফারেন্সগুলো লিস্টে নিয়ে আসছেন। আশা করি সব মামলারই শুনানি হবে। আমি প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে যেটুকু শুনেছি, উনি চাচ্ছেন আগে ডেথ রেফারেন্সগুলোর শুনানি শেষ করতে।

ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির এ দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে আইনজীবীরা জাগো নিউজকে জানান, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজ আদালত পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড হলে তা হাইকোর্টে অনুমোদন করাতে হয়। রায়সহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয় যা ‘ডেথ রেফারেন্স’ নামে পরিচিত। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিতরা কারাগারে থেকে জেল আপিল করতে পারেন। এছাড়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদনও করতে পারেন। হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করে।

আইনজীবীরা বলছেন, পেপারবুকে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, জব্দ তালিকা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও বিচারিক আদালতের রায় পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকে। এসব প্রক্রিয়া শেষে ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল, জেল আপিল ও আবেদনের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়। রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট মামলার নির্ধারিত দিনে রায় ঘোষণা করেন বিচারক।

সর্বাধিক পঠিত