• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

লঞ্চ ট্র্যাজেডিতে এগিয়ে এসে প্রশংসায় ভাসছেন দিয়াকুল গ্রামবাসী

প্রকাশ:  ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:৫৪
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

শীতের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন ঢাকার একটি প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নার্সিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুক্তা আক্তার। তার সঙ্গে ছিলেন বড় বোন মুন্নি বেগম, তার বড় ছেলে ফাহিম, ছয়মাস বয়সী আব্দুল্লাহ আল ইয়ামিন এবং চাচাতো বোন ফাতেমা আক্তার। পরিকল্পনা ছিল গ্রামে গিয়ে তারা শীতের পিঠা খাবেন আর আনন্দ-ফুর্তি করবেন। তবে সেই আনন্দ পরিকল্পনা বিষাদে রূপ নিয়েছে। লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই স্মৃতি তাদের তাড়া করছে।

মুক্তা আক্তার বলেন, ‘আমরা যেভাবেই হোক আল্লাহর পরে স্থানীয়দের সহায়তায় বেঁচে আছি। দিয়াকুলবাসী আগুন দেখে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। ওই এলাকার লোকজন যদি সহায়তা না করতো তাহলে আমরাও মনে হয় বাচঁতে পারতাম না। নিহতের সংখ্যা আরও বেড়ে যেতো।’

বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত গভীর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী লঞ্চ এমভি অভিযান-১০ এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের মধ্যে ৩৭ জনের বাড়িই বরগুনায়। ওই ঘটনায় আহত শতাধিক যাত্রী। নিখোঁজ অনেকে।

লঞ্চে আগুনের লেলিহান শিখা যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল তখন যাত্রীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেন ঝালকাঠি সদরের দিয়াকুল গ্রামবাসী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা দগ্ধ যাত্রীদের উদ্ধারে সহযোগিতা এবং পরবর্তী সেবার ব্যবস্থা করেন। এ ঘটনায় প্রশংসায় ভাসছেন দিয়াকুলবাসী।

দুর্বিষহ ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নার্সিংয়ের ছাত্রী মুক্তা আক্তার বলেন, ‘সদরঘাট টার্মিনালে বিকেল ৫টার দিকে লঞ্চে উঠে দোতলার সামনের দিকে আসন নেন। সাড়ে ৫টা বাজতেই লঞ্চে প্রচুর পরিমাণে লোক ওঠে। যারাই ইঞ্জিন রুমের কাছে বিছানা করতে যান, প্রচণ্ড গরমের কারণে তারাই ফেরত আসেন। এ অবস্থায় প্রায় আড়াই হাজার (আনুমানিক) লোক নিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় লঞ্চটি ছাড়ে। এরপর চাঁদপুর ও বরিশাল থেকেও প্রচুর পরিমাণে লোক তোলে। তিল ধারণেরও ঠাঁই ছিল না লঞ্চটিতে।’

তিনি বলেন, সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চের উপ্ততাও বাড়তে থাকে। আমরা স্টাফকে বারবার বললেও তারা আমাদের কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালের কাছাকাছি এলেই ধোঁয়ায় অক্সিজেন সংকটে শ্বাসকষ্টে যাত্রীরা ছোটাছুটি শুরু করেন। এসময় আমরা পাশে গিয়ে মাথা বাইরে দিয়ে শ্বাস নিতে শুরু করি। ওদিকে গরমে আমাদের পেছন পুড়ে যাচ্ছিল। উপায় না পেয়ে আমি ঝাঁপ দিয়ে বোন ফাতেমাকে বের হতে বলি। তাকেও টেনে বের করে ছোট বাচ্চাটাকে লঞ্চের একযাত্রীর সহায়তায় নামিয়ে আনতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি।

‘বড় বোনকে বের হতে বললে তিনি ঝাঁপ দেওয়ায় তীরে কাদা-পানির মধ্যে পড়ে যান। এতে তার দুই পা ভেঙে যায় এবং কোমড়ে প্রচণ্ড আঘাত পান। পরে তাকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বোনের বড় ছেলেটা হারিয়ে যায়। পরে আমাদের স্থানীয়রা উদ্ধার করে ট্রলারে নিয়ে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। আরও দুজন দগ্ধসহ পরে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় বাচ্চা দুটোকে ফিরে পাই।’

স্থানীয়দের প্রশংসা করে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া মুক্তা আক্তার বলেন, ‘ছোট বাচ্চাটা পানিতে ভিজে যাওয়ায় তার পোশাকও পরিবর্তন করে দেয় স্থানীয়রা। বড় বাচ্চাটার হাত আগুনে পুড়ে যায়। সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বড় বোন মুন্নি বেগমের কাছে পৌঁছে দেন তাদের। পরে উন্নত চিকিৎসার চিকিৎসার জন্য বড় বোনকে সদর হাসপাতাল থেকে বরিশাল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। বাচ্চা দুটো এখন বড় বোনের কাছে আছে। আমরা দুই বোন (মুক্তা ও ফাতেমা) সদর হাসপাতালে ভর্তি আছি।’

মুক্তা ও ফাতেমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জীবনে এমন বিপদে আর কখনোই পড়ি নাই। কীভাবে মানুষ পোড়ে, পোড়া মাংস কীভাবে খসে খসে পড়ে তাও দেখলাম। নিজেও পুড়েছি, বোনও পুড়েছে। মারাত্মক পোড়া মানুষের সঙ্গে ট্রলারে করে হাসপাতালে আসতে হয়েছে। তবে নদীর পাড়ের স্থানীয় মানুষ যেভাবে আমাদের সহায়তা করেছে তাতে তাদের ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে না।’ বলে কেঁদে দেন দুই বোন।

ঝালকাঠিতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের সময় যাত্রীদের উদ্ধার ও সাঁতরে তীরে আসা যাত্রীদের গরম পোশাক দিয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়ান ঝালকাঠি সদরের দিয়াকুল গ্রামের মানুষ। লঞ্চে আগুন লাগার পরপরই এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে ছুটে যান। প্রচণ্ড কুয়াশা আর তীব্র শীত উপেক্ষা করে সুগন্ধা নদীতে ঝাঁপ দেন যাত্রীদের বাঁচাতে।

এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, ঘটনার পরপরই তারা জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ কল করেন। তবে তারা সহায়তা পাননি। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকালে। কিন্তু গ্রামের লোকজন রাতেই উদ্ধারকাজে হাত লাগান। অনেকেই ট্রলার নিয়ে লঞ্চের কাছে ভেড়ার চেষ্টা করেন, যদিও আগুনের তাপের কারণে তাদের পক্ষে লঞ্চে উঠে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি। পরে লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া যাত্রীদের ট্রলারে করে তারা নদীর তীরে নিয়ে যান। নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেন। ভেজা কাপড় পাল্টে তারা যেন গরম কাপড় পরতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করেন।

দিয়াকুল গ্রামের যুবক রুশাদ ও শাকিল বলেন, ‘লঞ্চ থেকে যখন শিশুদের চিৎকার ভেসে আসে, তখন তাদের বাঁচাতে এগিয়ে যান তারা। বড়রা যখন তাদের জীবন বাঁচাতে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ছিলেন, তখন দুটি শিশু লঞ্চ থেকে চিৎকার করছিল। এই দৃশ্য দেখে একটি ট্রলার নিয়ে ওদের বাঁচাতে এগিয়ে যাই। তাদের ট্রলারে উঠিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি শিশু আগুনের তাপে দুর্বল হয়ে নদীতে পড়ে যায়। আরও কয়েক শিশুকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে যেতে দেখলেও তাদের রক্ষা করতে পারিনি। আগুনের তাপে লঞ্চের কাছে যেতে পারছিলাম না। শুধু চোখের পানি ফেলেছি দূর থেকে।’

বেঁচে ফেরা একাধিক যাত্রীর অভিযোগ, ঝালকাঠি শহরের কাছে আসতেই লঞ্চের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তীরে ভেড়ানোর চেষ্টা করেনি। পরে আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়লে সদরের চর ভাটারকান্দা গ্রামের চরে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন লঞ্চটির চালক। কিন্তু সেখানে লঞ্চটি ভেড়াতে পারেননি। ওপারের দিয়াকুল গ্রামে গিয়ে লঞ্চটি ভেড়ে। তবে চর ভাটারকান্দা গ্রামের দুই শতাধিক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

লঞ্চযাত্রী বরগুনার লাকুরতলার আহসান হাবিব বলেন, সেই রাতে দিয়াকুল গ্রমের মানুষ যে মানবিকতা এবং উদারতা দেখিয়েছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবার মতো। তারা সময়মতো উদ্ধারকাজে নেমে পড়ায় অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। তারা গরম কাপড়, টাকা ও খাবার দিয়ে সহায়তা করেছেন।

চর ভাটারকান্দা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী বৃৃষক হেমায়েত হোসেন বলেন, লঞ্চটি চর ভাটারকান্দা গ্রামের চরে আটকাতে পারলে হতাহতের সংখ্যা আরও কম হতো। চর ভটারকান্দার মানুষ দুই শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদে পাড়ে পৌঁছে দিয়েছেন।

ঝালকাঠি পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ূন কবির সাগর চারটি ট্রলার ভাড়া করে দেড় শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধারে তৎপরতা চালান।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আগুন’, ‘আগুন’ বলে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হই। দেখি, দক্ষিণ দিকের আকাশ লাল। নদীর মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছে একটি লঞ্চ। তখন বুঝতে পারি যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন লেগেছে। দ্রুত ছোটাছুটি করে এলাকার ছোট ভাইদের ডাকি। একে একে এলাকার ২৪-২৫ জন আমার সঙ্গে বের হন। ওদের নিয়ে চারটা ট্রলার ভাড়া করে লঞ্চের দিকে যাই। তবে আগুনের তাপে লঞ্চের কাছে যেতে পারছিলাম না। কিন্তু লঞ্চ থেকে অনেক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রলারের দিকে সাঁতরে আসেন। আমরা তাদের ট্রলারে তুলতে থাকি। দেড় শতাধিক যাত্রীকে নদীর তীরে নিয়ে আসি।’

সর্বাধিক পঠিত