• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

ফিফটির দরোজায় আমি কেবল ভাবছি...

প্রকাশ:  ০৩ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:০১ | আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:১৬
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি)
প্রিন্ট

মানুষের জীবনে সবচেয়ে অনিশ্চিত তাঁর জীবনকাল। এক একটি বছর যায় আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে নত হই, কৃতজ্ঞতা জানাই। শৈশবে মৃত্যুকে প্রচণ্ড ভয় ছিল, সময়ের সাথে জেনেছি মৃত্যু মানে ভয় নয় এক ধরণের বোঝাপড়া । জীবনটা আসলে রিলে রেসের মতো একজনের কৃত কাজ অপরজন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমি নিশ্চিত জানি না আমার প্রয়োজন ঠিক কোথায় যেয়ে শেষ হবে, যেমন জানি না আমার বাকি কর্ম সমূহ। সারা দিনমান খুঁজে ফিরি, কর্মের সন্ধান করি। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে সৃষ্টিকর্তার একটি উদ্দেশ্য থাকে। আমি সেই উদ্দেশ্যের সন্ধানে ব্যাপৃত হই।

যখন কোন বুভুক্ষ লোক ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে ভাবি ওর অন্ন সংস্থানই আমার কাজ। যখন কোন অসুস্থ মানুষ দেখি, ওর চিকিৎসা করানো জরুরী, ভাবি এটা আমার কাজ। যখন কোন অসামঞ্জস্য অসহায় মানুষ দেখি ভাবি ওর পাশে দাঁড়ানোটাই আমার কাজ। কিন্তু রুখে দাঁড়ানো প্রতিবাদ করতে পারাটা এতোটা কি সহজ ! স্বার্থান্বেষী মানুষের স্বার্থে আঘাত করলে বিষাক্ত সাপের মত ফোঁসে উঠবে, ছোবল দিতে চাইবে ।

জীবনের এতোগুলো বছর পেরিয়ে মনে হচ্ছে এক নিমিষেই শেষ । এই তো সেদিন হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখা, বাবার কোলে চড়ে ঘুরতে যাওয়া, মায়ের আঁচল ধরে জেদ আর আহল্লাদে আটখানা। ফুল পাখী আর প্রজাপতির সাথে সখ্যতা করে করে আমার বেড়ে উঠা। অমন একটি পরিবারে জন্ম না হলে আমি জানতামই না জীবন কতোটা মায়াময় হতে পারে । কতো কম চাহিদায় মানুষ কতো বেশী সুখী হতে পারে।

ঠিক যেমন বিয়ে না হলে জানতাম না মানুষে মানুষে একাত্মতা, অন্যকে সাহায্য করা, অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পরা। অন্যের সুখে, অন্যের হাসিতে নিজের আনন্দ, সুখ আর এক ধরণের প্রশান্তি খুঁজে ফেরা।

স্বামীর মৃত্যুর পর জেনেছি মানুষ কতোটা ছলচাতুরী, স্বার্থান্ধ, নিষ্ঠুর আর নির্দয় হতে পারে। মুহূর্তে ভোল পাল্টে মানুষ কতোটা বেঈমান আর অকৃতজ্ঞ হতে পারে । সেই সাথে আরও জেনেছি পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষও আছেন। যারা কোনদিন কোন সাহায্য নেননি স্বার্থের তোয়াক্কা করেন না কেবলই বিবেকের তাগিদে পাশে এসে দাঁড়ান, সাহায্য করেন। মৃত্যুর পরের কথা জানিনা কিন্তু জীবনে এদেরকেই আমি আল্লাহ্‌র প্রেরিত পুরুষ তথা মানুষ রূপী ফেরেশতা বলে বিশ্বাস করি। কারণ দিনে প্রতিটি সময় আমি কেবল মহান সৃষ্টিকর্তার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি, নতজানু হই।

মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে মনে হয় এই নোংরা অভিজ্ঞতা গুলোর কি প্রয়োজন ছিল আমার ! পরক্ষনেই কে যেন আমার মাথায় স্নেহের পরশ বুলায় বলে, '' ধৈর্য ধর''। জীবন কেবল পরীক্ষা বৈ আর কিছু তো নয় !

জীবনে প্রতিটি পাওয়ারই মূল্য পরিশোধ করতে হয় তা মায়া-মমতা, আদর-ভালোবাসা, মান-সম্মান যাই হোক না কেন । জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ গুলো আমি অনায়াসে অনেক সস্তা দামে পেয়ে গেছি । হয়তো আমার উপর আল্লাহ্‌র বিশেষ রহমত কিংবা তাঁর প্রদত্ত উপহার যা আমি জন্ম লগ্নে তাঁর কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলাম ।

কিন্তু বস্তুগত যে সম্পদ তা পেতে আমায় নিয়ত অকৃতজ্ঞ, স্বার্থান্ধ, ছলচাতুর মানুষদের কূট কৌশলে পড়তে হচ্ছে। স্বামীর মৃত্যু না হলে হয়তো জানতামই না মুমূর্ষু রোগীর শয্যা পাশে শিয়রে বসে মানুষ কতোটা ঘৃণ্যভাবে নিজের স্বার্থ বুঝে নিতে এতোটা নীচে নামতে পারে।

যখন ভীষণ ক্লান্ত আর অসহায় লাগে নিজে নিজেকে সান্ত্বনা দেই, পুরো জীবনটাই তো পরীক্ষা আর পরীক্ষা লব্ধ অভিজ্ঞতার সমাহার মাত্র, এতো অল্পতে ভেঙ্গে পরলে চলবে কেন !

মাঝে মাঝে আমার প্রভু, সৃষ্টিকর্তার সাথে সরাসরি কথা বলতে ইচ্ছে জাগে। মনে হয় তাঁকে যেয়ে জিজ্ঞেস করি, '' কেন আমি '' ! পরক্ষনেই মনে হয়, তিনিই তো অপার হস্তে দিয়েছেন আমায় । এই যে বৃষ্টি ভেজা ভোরের আলো, মৃদুমন্দ বাতাস পাখীদের কলকাকলি, আমার ঘর আলো করে প্রস্ফুটিত দুটি গোলাপ আমার দুই সন্তান সব কিছুতো তিনিই দিয়েছেন। তবে আর তাঁকে মিছেই দোষারোপ কেন !

আবার মনে হয় তবে কি জন্ম লগ্নে বাধ্য বাধকতা ছিল একটি চাইলে অপরটি পাওয়া যাবে না। এই যেমন যারা শ্রমিক শ্রেণীর তাঁদের পেট পুরে নিশ্চিতির ঘুম আর যারা ধনিক শ্রেণীর বেনিয়া-সউদাগর-ব্যবসায়ী প্রতি মুহূর্তে তাঁদের টেনশন আর ভয় । আমার ভয় নেই আবার ঘুমও খুব প্রিয়, তবে কি আমার শ্রমিক হওয়ারই কথা ছিল ! খানিকটা দ্বিধান্বিত হই। আবার ভাবি, আমি শ্রমিকই তো সুবেহ সাদেক থেকে ঘুমনোর পূর্ব মুহূর্ত কেবলই কাজের মাঝে ডুবে থাকা । হ্যাঁ আমি মেধা শ্রমিক।

জানি বেঁচে থাকার জন্য ধন সম্পদ কোন কিছুই অত্যাবশ্যক নয় কিন্তু তাই বলে চোখের সামনে অন্য কেউ অন্যায় ভাবে কুক্ষিগত করবে আর আমি টুঁ শব্দটিও করবো না তবে সৃষ্টিকর্তা আমায় সাহস দিয়েছেন কেন, প্রতিবাদের ভাষা এবং মেধাই বা দিয়েছেন কেন ? তাঁর প্রদত্ত প্রতিটি সম্পদের যথাযথ ব্যাবহার করার অঙ্গীকারেই তো আমার এই পৃথিবীতে আসা। আমার দুই সন্তানের দায়িত্ব তো তিনি আমার উপড়েই অর্পণ করেছেন।

আমি প্রতিদিন সময় অনুযায়ী দুহাত তুলে কৃতজ্ঞ চিত্তে তাঁকে স্মরণ করি। ভাগ্যিস তিনি আমার ভিতর হিংসা, লোভ, ছল চাতুরী দেন নাই ! এগুলো থকলে তো নিজের জীবনই বিষিয়ে উঠে, এ জগতেই জাহান্নামের আগুনে জ্বলে-পুড়ে খাক হতে হয় । 

খুব অল্প কিছুতে আমি খুশী হই, একটি সুন্দর ফুল, রঙিন পাখী কিংবা শিশুর নিষ্পাপ মুখ আমায় সুখী করে আনন্দ দেয় । এটাকে আমি সৃষ্টিকর্তার উপহার বলে মনে করি। অনেক বেশী চাহিদা থাকলে নিজেকে সুখী করা আনন্দ দেওয়া অনেক বেশী কষ্ট সাধ্য হয়ে পরে । অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় চাইতে চাইতে জীবনই শেষ হয়ে যায় তবুও পাওয়া হয় না কারণ মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা কখনো পুড়ন হবার নয়।


জীবনের বেশীরভাগ সময় পার হওয়ার পরও উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছি না তবে কি নিকটবর্তী ভবিষ্যতেই আমার পরিসমাপ্তি ! ৫০ পেরোনোর পর নাকি জীবন ছোট হয়, বয়স কমে। মৃত্যু যখনই আসুক আমি প্রস্তুত ।

লেখক: সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ