• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তি, আইন কী বলে?

রীনা আকতার তুলি

প্রকাশ:  ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:৫০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

নকলের অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারী (১৫) আত্মহত্যা করেছে। সম্প্রতি তার এই আত্মহত্যা দাগ কেটেছে সাধারণ মানুষ ও অভিভাবকদের মনে। এখন অনেক বাবা-মা শঙ্কিত তাদের সন্তানকে নিয়ে।
    অরিত্রির এ ধরনের আত্মহত্যা প্ররোচনামূলক বলে বিবেচিত। কারণ নকল ধরা পড়ার পর স্কুলে ডাকা হয় বাবা দিলীপ অধিকারী ও মা বিউটি রাণীকে। মেয়ের সামনে মা-বাবাকে অপমান করা হয়। এ সময় অরিত্রি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের পা ধরে পরীক্ষা দেয়ার জন্যে কান্নাকাটি করলেও তিনি কোনোমতেই পরীক্ষা দিতে দেননি। বরং টিসি দেয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
    ঘটনার দিনের কথা বর্ণনা দিয়ে দিলীপ অধিকারী বলেন, অরিত্রিকে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেবে না এমন সংবাদ পেয়ে মেয়ে আমাদের স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করে।
স্কুলে যাওয়ার পরে আমাদের পদে পদে অপমান করা হয়। স্কুলে ঢুকতেই ঘাম ঝরে যায়। স্কুলে গিয়ে প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে যাই। এরপর অরিত্রির কথা ওঠাতে তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেন, কেমন মেয়ে মানুষ করেছেন, পরীক্ষায় নকল করে? আমরা ওর ব্যাপারে গভর্নিংবডির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। এ সময় আমরা মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাই। কিন্তু তিনি কোনো কিছুই শুনতে রাজি হননি। তার কিছুই করার নেই জানিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এরপর অরিত্রিকে সঙ্গে নিয়ে প্রিন্সিপালের রুমে যাই। সেখানে যাওয়া মাত্রই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলেন, ‘ও আপনিই অরিত্রির বাবা! ওর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাকে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। কেস ফাইল করা হয়েছে। কালকে এসে টিসি নিয়ে যাবেন। আমি তখন ম্যাডামকে মেয়ের হয়ে ক্ষমা চাই। এর মধ্যেই অরিত্রি ম্যাডামের পা ধরে কান্না করে ক্ষমা চায়। কিন্তু তিনি কিছুতেই অরিত্রিকে ক্ষমা করতে রাজি হননি। পরীক্ষায় অংশ নিতে দেননি।’
    দিলীপ অধিকারী আরও বলেন, সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে অরিত্রির আরও একটি পরীক্ষা ছিলো। ওই পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্যে খুব চেষ্টা করেছিলো মেয়ে আমার। ম্যাডামের কাছে আমরা বারবারই অনুরোধ করেছিÑসন্তান ভুল করেছে, এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। কিন্তু তিনি কোনোমতেই রাজি হননি। এর মধ্যে অরিত্রি ম্যাডামের রুম থেকে কখন যে বেরিয়ে যায় আমরা খেয়াল করিনি। মেয়েকে না পেয়ে কলেজের ভেতর অনেক খোঁজাখুঁজি করি। কিন্তু সবার একই পোশাক হওয়ায় বুঝতে অসুবিধা হয়। এর মধ্যে আমি ওর মাকে বাসায় পাঠিয়ে দিই। মেয়ে বাসায় গেছে কিনা খোঁজ নিতে।
    অরিত্রির মা বিউটি রাণী বলেন, ‘আমি বাসায় পৌঁছে দেখি মেয়ে বাসায় এসে কান্না করছে। আমি তাকে সান্ত¡না দিয়ে বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে মা। এর মধ্যে সে তার নিজের রুমে ঢুকে বেডে শুয়ে পড়ে। আমি পাশের রুমে অরিত্রির জন্যে পেয়ারা কাটতে যাই। পেয়ারা নিয়ে যেতেই দেখি দরজা বন্ধ। তখন আমি দৌড়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে অরিত্রিকে ডাকাডাকি করি। কোনো শব্দ না পেয়ে ওর বাবাকে জানাই। এর মধ্যে বাসার কাজের লোকজনকে ডেকে দরজা ভেঙে রুমে প্রবেশ করে দেখি ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে আমার মা।’
    এ ধরনের আত্মহত্যাকে প্ররোচনামূলক আত্মহত্যা বলে। মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে নবম শ্রেণিতে পড়া অরিত্রির আত্মহত্যা ছিলো প্ররোচনামূলক আত্মহত্যা।

প্ররোচনা কীভাবে হতে পারে?
    মানুষকে নেতিবাচকভাবে ও মানসিকভাবে আকার-ইঙ্গিত বা কাজের দ্বারা দুর্বল করে তার বেঁচে থাকাটা অর্থহীন করে তোলা যায়। কোনো মানসিক রোগীকে যদি বোঝানো হয় যে, সে সমাজের পরিবারের বোঝা, তাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তার বেঁচে থাকাটা অপ্রয়োজনীয়, তবে তা আত্মহত্যায় প্ররোচনাদায়ক। অমুককে বাঁচানোর জন্যে তমুককে বিপদে ফেলে দেয়া প্ররোচনা। তিলে তিলে কারও স্বপ্ন আশা ভেঙে দিয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনা। তীব্র অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, উত্তেজিত করা কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা।

আইন কী বলে?
    বাংলদেশ দ-বিধি, ১৮৬০-এর ৩০৬ ধারা অনুযায়ী-ব্যক্তির আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তি ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং জরিমানা। তবে আত্মহত্যা করতে গিয়ে না মরলে আপনাকে আত্মহত্যা বা নিজেকে ধ্বংস করার অপচেষ্টার অপরাধে এক বছরের জেলে যেতে হতে পারে। দ-বিধির ৩০৯ ধারামতে, যদি আপনি আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নেন এবং অনুরূপ অপরাধ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করেন তাহলে আপনার এক বছর পর্যন্ত কারাদ- বা জরিমানা হতে পারে বা উভয় শাস্তিই হতে পারে।
    এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডঃ সালমা হাই টুনী বলেন, অরিত্রির আত্মহত্যা প্ররোচনামূলক। কারণ তাকে নকলের অভিযোগে বিকারগ্রস্ত করে, বাবা-মাকে ডেকে অপমান করা, শিক্ষকের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করা, টিসি দেয়ার সিদ্ধান্তÑএসব অরিত্রিকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছে। তিনি বলেন, আইন অনুসারে অরিত্রির আত্মহত্যায় তার শিক্ষকদের দায়ী করা যায়। এছাড়া আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পুরোপুরি বাণিজিকীকরণে পরিণত হয়েছে। টাকা ছাড়া শিক্ষকরা কিছু বোঝেন তা। বোর্ডের বইয়ের বাইরে হাইকোর্টের রুল অমান্য করে অনেক বাড়তি বই চাপিয়ে দেয়া হয়, যা গুরুতর অন্যায়। এছাড়া বর্তমানে শিক্ষকদের আচরণে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তারা শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক অত্যাচার করে, যা শিক্ষার্থীরা লজ্জায় বলতে চায় না। তিনি আরও বলেন, অরিত্রির এ ঘটনা পুরো বাংলাদেশের চিত্র। অরিত্রির ঘটনা মিডিয়া তুলে ধরেছে, তাই আমরা জানতে পেরেছি। এ রকম হাজারো অরিত্রি এভাবে কলিতেই ঝরে যায়; কিন্তু আমরা জানতে পারি না। এসব আড়ালে থেকে যায়। সালমা হাই বলেন, শিক্ষার্থীদের এভাবে আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী শিক্ষকদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
    উল্লেখ্য, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নকলের অভিযোগ তুলে বাবা-মাকে ডেকে অপমান ও টিসি দেয়ার কথা বলায় রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শান্তিনগর শাখার নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রি (১৫) গত ৩ ডিসেম্বর দুপুরে আত্মহত্যা করে।

সর্বাধিক পঠিত