• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ

মোঃ আনোয়ার হাবিব কাজল

প্রকাশ:  ২৬ মার্চ ২০১৯, ১০:২২
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এই শব্দ তিনটি একইসূত্রে গাঁথা। প্রতিটি শব্দই একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি কল্পনাও করা যায় না। বঙ্গবন্ধুর জাতিগত পরিচয়, জীবন, কর্মপরিধি ও দেশাত্মবোধ এতই গভীরে প্রোথিত যে, আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের পক্ষে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লেখা সত্যিই দুরূহ কাজ। তারপরও শৈশব-কৈশোর থেকেই প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে মুজিববাদী ছাত্রলীগের রাজনীতির সংস্পর্শে থাকার সুযোগ হয়েছিল সহপাঠীদের কল্যাণে। বিশেষ করে প্রয়াত বন্ধু চাঁদপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি আবদুর রব এমপি’র পুত্র চাঁদপুর সরকারি কলেজের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাবেক ভিপিপ্রার্থী রেজওয়ানুর রব রাজুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে এবং তৎকালীন কালীবাড়ী মোড়ের টাউন হলের নিচের কামাল ভাইয়ের বন্ধু মুদ্রায়নের আড্ডা এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি বাহাদুর বেপারী, সমাজ সেবা সম্পাদক  হালিম, শহীদুল্লাহ হলের সভাপতি মাইনু, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলের নেতৃত্বদানকারী সবচেয়ে লম্বা ও দীর্ঘদেহী ছাত্রলীগ কর্মী জসিমের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে। কিন্তু লেখালেখির অভ্যাস থেকে পরবর্তীতে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়ার পর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে আর সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ হয়ে উঠেনি। গণতন্ত্রের মানসকন্যা, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার  জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ক্রমাগত উন্নয়ন ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীর প্রাক্কালে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তার গৌরবোজ্জ্বল জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখার জন্যে আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
    হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তাই তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তাঁরই আহ্বানে ও নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র জন্ম নেয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি জাতীয় পতাকা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ দিয়েছেন। সে মূল্যায়নে তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি এ দেশের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর জীবনের এক চতুর্থাংশেরও বেশি সোনালি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের স্মরণীয় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-এর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নাম একই সূত্রে গাঁথা। তাই বঙ্গবন্ধু মানেই সোনার বাংলা এবং স্বপ্নের বাংলাদেশ।
    ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের নিভৃতপল্লী টুঙ্গী পাড়ায় শেখ বাড়িতে শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের সংসারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা মা তাকে আদর করে ডাকতেন খোকা বলে। ৭ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ালেখা করেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনার সময় তিনি চোখের দুরারোগ্য বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় (তার ব্যবহৃত চশমা যার প্রমাণ) কয়েক বছর তার পড়াশোনা বন্ধ থাকে। ১৯৪১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এখানে অধ্যয়নকালেই মূলতঃ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রাথমিক বিকাশ ঘটে। তাঁর সাহসিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, বাগ্মিতা ও নেতৃত্বের গুণাবলির কারণেই সমসাময়িক অনেককে পিছনে ফেলে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র সংঘের সম্মেলনে যোগ দেন। বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে শেখ মুজিবুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন।
    ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং পিতার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। স্বদেশপ্রেমের আবেগেই তিনি প্রথম যৌবনে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় মাস না পেরুতেই তিনি উপলব্ধি করতে পারেন বাঙালিরা স্বাধীন হলেও মুক্তি পায়নি। সেই অনুভূতি ও বিশ্বাস থেকেই সমমনা প্রগতিশীল ছাত্র নেতা-কর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি শেখ মুজিব গঠন করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ যা আজকের ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামে পরিচিত। সহসাই তিনি শাসক গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রায় সকলেই জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফেরৎ পান। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান মুচলেকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর এই একগুঁয়েমি ও বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের জনক ও গভর্নর জেনারেল কায়েদ-ই আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা গোষণা করলে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্র নেতা-কর্মী সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। পরদিন ভাষার দাবিতে সচিবালয়ের সামনে মিছিল থেকে তাঁকে আবারো গ্রেফতার করা হয়। বেশ কিছুদিন আটক থাকার পর তাঁকে জেল থেকে ছাড়া হলে টাঙ্গাইলে একটি সভায় সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় তিনি বক্তব্য রাখেন। ফলে শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় শেখ মুজিবকে পুনরায় কারাগারে পাঠানো হয়।
    নতুন রাষ্ট্র প্রাপ্তির মোহভঙ্গ হলে এই নব রাষ্ট্রেরই প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠিত অনেক রাজনীতিকের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তারিখে ঢাকার বিখ্যাত রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এবং কারাগারে অন্তরীন শেখ মুজিবকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫০ সালে কারামুক্ত হয়ে বাইরে এসে দেশের দুর্ভিক্ষাবস্থা ও ক্ষুধার্ত মানুষের করুণ চিত্র তাঁকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে। ঢাকায় ভুখা মিছিল আয়োজন ও নেতৃত্বের অপরাধে আবারো তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। এবার ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি কারাগারের বাইরে আসেন। কিন্তু খাজা নাজিম উদ্দিন কর্তৃক পুনরায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষিত হলে পূর্ববাংলা গর্জে ওঠে। স্বাভাবিক নিয়মেই শেখ মুজিবকে বাইরে রাখা নিরাপদ নয় ভেবে আবারো বন্দী করা হয়। রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ ও তা আরো বেগবান করার লক্ষ্যে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিব ও মঠবাড়িয়ার মহিউদ্দিন আহমেদ জেলখানায়ই আমরণ অনশন শুরু করেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারির পুলিশের গুলিতে নিহতদের সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছালে তারা অনশন ও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি অনশনের ১১তম দিনে শেখ মুজিবের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সরকার তাকে মুক্তি এবং বাইরের হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হয়।
    ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি এবং হক-ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর প্রতি সম্মান ও আনুগত্যের কারণে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। নির্বাচনে গোপালগঞ্জের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতা ওয়াহিদুজ্জামানের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে শেখ মুজিব সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের তরুণ নেতা অথচ প্রভাবশালী মন্ত্রী হন। অল্পদিন পরই যুক্তফ্রন্ট সরকার বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আর শেখ মুজিবুর রহমানের স্থান হয় সোজা কারাগারে। বছর খানেক কারাভোগের পর বাইরে এসে তিনি গণপরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ও নির্বাচিত হন।
    ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ইসকান্দর মির্জাকে হটিয়ে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন এবং সামরিক শাসন জারি করেন। আর নিজ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী ও ঝামেলামুক্ত করার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবকে দ্রুতই কারাগারে পাঠান। এরপর ১৯৬১ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের নির্দেশে সামরিক সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলেও ডিক্রি জারি করে। অতএব পুনরায় জেলে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই গোপনে তিনি তাঁর স্বপ্ন অর্থাৎ স্বাধীনতার মহাপরিকল্পনা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে তুলে ধরেন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী গোপনে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং মহকুমা-থানা পর্যায়ে নিউক্লিয়াস গঠন করা হয়। নথি ও দালিলিক তথ্য প্রমাণ না পেলেও কিছু একটা হচ্ছে এটি আঁচ করতে পেরে ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে জননিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। ১৯৬২ সালের ৮ জুন সামরিক শাসন প্রত্যাহার হওয়ার পর তিনিও জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলনে নামলে ওয়াজি উল্লাহ ও বাবুল শহীদ হন। এই আন্দোলনের পেছনেও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। ১৯৬৩ সালে মোনায়েম খান গভর্নর নিযুক্ত হলে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। গভর্নর হয়ে তিনি এই মর্মে হুংকার ছাড়েন যে, মোনায়েম খান যতদিন এই চেয়ারে আছে ততদিন শেখ মুজিব জেলের বাইরে থাকতে পারবে না। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে বৈরুতে নেতা সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক অভিভাবক হারান এবং আওয়ামীলীগের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। ২৫ জানুয়ারি ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হলে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
    ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ পাকিস্তানের জন্যে আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট এবং শেখ মুজিব কর্তৃক বাঙালিদের ঘুম জাগানিয়া গান শোনানোর সুযোগ এনে দেয়। এই যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর চরম অবহেলা শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার পথে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়ার তাগিদ দেয়। শেখ মুজিব প্রথম সারির কয়েকজন বিশ্বস্ত দলীয়  নেতা এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং নিজের লক্ষ্য তুলে ধরেন। তুলে ধরেন ঐতিহাসিক ছয় দফা (বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ)। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শেখ মুজিব তাঁর ছয় দফা উপস্থাপন করেন। ছয় দফা নিছক তাঁর স্বায়ত্ত শাসনের দাবি নয়, ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যাওয়ার সূক্ষ্ম পরিকল্পনাও। তাই শাসক গোষ্ঠী তো বটেই এমনকি বাংলার অনেক বাঙালি নেতা ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদের সনদ আখ্যায়িত করে তা নাকচ করে দেন। তারা প্রকারান্তরে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের শত্রু আখ্যায়িত করেন। পরদিনই শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ফিরে আসেন। পহেলা মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।  ছয় দফাকে জনগণের দাবিতে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি এবার পূর্ব পাকিস্তানের মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর চষে বেড়ান। ছয় দফার দাবিতে খুব দ্রুত গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। ছয় দফার পক্ষে প্রচারণা বাধাগ্রস্ত করতে আইয়ুব-মোনায়েম সরকার তাঁর বিরুদ্ধে সিলেট-খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়া-ময়মনসিংহ-নারায়ণগঞ্জ-ঢাকায় একের পর এক মামলা ও হয়রানির খেলায় মেতে উঠে। তিন মাসে তাঁকে মোট আটবার আটক ও মুক্তি দেয়া হয়। এই নাটিকার শেষ দৃশ্যে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুন ’৬৬ তাঁর মুক্তির দাবিতে আহূত ধর্মঘট চলাকালে তেজগাঁওয়ে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক মনু মিয়া মারা যান। এরপর গ্রেফতার দেখিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বার আসামী করে ৩৪ জন বাঙালি আমলা, রাজনীতিবিদ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবেশী দেশ ভারতের সহায়তায় তারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও মুজিবের মুক্তির দাবিতে জনগণ সোচ্চার হয়, আন্দোলনে রাস্তায় নামে। স্লোগান তোলে ‘জেলের তালা ভাঙব-শেখ মুজিবকে আনবো’। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এই আন্দোলনের আগুন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আইয়ুব সরকার ১লা ফেব্রুয়ারি ’৬৯ রাওয়ালপিন্ডিতে সকল রাজনৈতিক দলের এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। নজিরবিহীন হলেও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ এবং প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু শেখ মুজিব প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এমতাবস্থায় আগরতলা মামলা সত্য কি মিথ্যা তা প্রমাণের পূর্বেই ১২ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোগীদেরকে সরকার বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ছয় দফা দাবি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য ঘটে যাওয়া সফল গণঅভ্যুত্থান এই অঞ্চলে তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। মুক্তিলাভের পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে গণসংবর্ধনায় জাতির পক্ষে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন থেকে শেখ মুজিব নিজ নাম অপেক্ষা ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে অধিক পরিচিতি লাভ করেন।
    ১০ মার্চ ’৬৯ বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত শেখ মুজিবুর রহমান পিন্ডির গোলটেবিলে তার ছয় দফার সঙ্গে ছাত্রদের এগারো দফা দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। কিন্তু পূর্বের ন্যায় শাসক গোষ্ঠী তা অগ্রাহ্য করে। ২৫ মার্চ তারিখে আইয়ুব খানকে হটিয়ে ইয়াহিয়া খানের আবির্ভাব ঘটে। তিনি সামরিক শাসন জারি করেন। ফলে রাজনীতি আবারও অনিশ্চয়তার গহ্বরে নিপতিত হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির নাড়ির স্পন্দন বুঝতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, হাজার বছরের ঘুমন্ত জাতি এবার জেগে উঠেছে এবং তারা তাঁর পেছনে আছে ও তাঁর প্রতি বাঙালিদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য এখন বাঙালিদের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট প্রয়োজন। অতঃপর তিনি নতুন সামরিক সরকারের কাছে এক ব্যক্তির এক ভোটের নির্বাচন দাবি করেন। ৫ ডিসেম্বর ’৬৯ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি যে, আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি পুনঃনির্বাচিত হন। মার্চে সরকারের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। ৭ জুন ’৭০ মনু মিয়ার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে রেসকোর্সে ছয় দফাকেই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর ’৭০ জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদের নির্বাচনে যথাক্রমে ১৬২ ও ২৬৪ আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়ে যায়। নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে ইয়াহিয়া খান বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিনন্দন ও ৩রা মার্চ ’৭১ তারিখে সংসদ অধিবেশন আহ্বান করেন। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আনন্দের বাতাস বইতে থাকে। এই প্রথম বাঙালিরা দেশ শাসনের আধিকার পেতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা ও সরকার গঠনের প্রস্তুতি শুরু করে।
    বাঙালিরা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে কিন্তু তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে শাসকগোষ্ঠী বদ্ধপরিকর থাকে। জানুয়ারি মাসে পিন্ডি ও লারকানায় ইয়াহিয়া, ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডারগণ দফায় দফায় বৈঠক করে একমত হয় যে, আপাতত শেখ মুজিব পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হলেও তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে পূর্বাঞ্চলকে অর্থনৈতিক ও সামরিকক্ষেত্রে স্বাবলম্বী করামাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। অতএব সিদ্ধান্ত হয়ে যায় যে, মার্চের শেষ নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু এবং এপ্রিলের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। তাদের পরিকল্পনার ভিতর ছিল প্রথমেই শেখ মুজিবকে আটক করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাঁসিতে ঝোলানো।
    ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়টি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ঘটনাবহুল অধ্যায়। পহেলা মার্চ হঠাৎ অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হলে বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু জনতাকে ধৈর্য ধারণ ও শান্ত থেকে বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ২ ও ৩ মার্চ হরতাল কর্মসূচি পালন শেষে ৪, ৫ ও ৬ মার্চ তারিখে মানুষ ৭ মার্চকে সামনে রেখে এগুতে থাকে ঢাকা অভিমুখে। পুরো ঢাকা শহর কাঁপতে থাকে মিছিলের পদভারে। সব মিছিলের একই আওয়াজ-‘শেখ মুজিবের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। আর লক্ষ্যস্থল ঢাকার রেসকোর্স ময়দান, যেখানে লিখিত হতে যাচ্ছে একটি জাতির ভবিষ্যৎ, একটি ইতিহাস। কোনো প্রকার কাগুজে সহায়তা ছাড়া আঠারো মিনিটের যে বক্তৃতা তিনি করলেন, তা রীতিমতো যুদ্ধের অপারেশন অর্ডার। যেন আজ তিনি এক গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞ সেনাপতি হিসেবে আবির্র্ভূত হয়েছেন। বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ, বাক্য, কণ্ঠের উত্থান-পতন সবই ছিল চুম্বকের ন্যায়, আকর্ষণীয় মন্ত্রমুগ্ধকর এবং সর্বোপরি সময়োপযোগী। শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র নিয়ে শঙ্কিত শেখ মুজিব বলেন, ‘‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল... আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, রাস্তা-ঘাট যা কিছু আছে, তোমরা সব বন্ধ করে দেবে...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’’ বঙ্গবন্ধু তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সবুজ সংকেত দিয়ে দিলেন।
    ৮ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবের নির্দেশ বাঙালিরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ চালাতে থাকে, পাশাপশি চলে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি। ১৬ মার্চ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সাংবিধানিক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনা শুরু করেন। শেখ মুজিব প্রতিপক্ষের মুখচ্ছবি দেখে মনের সম্পূর্ণ চিত্রই পড়তে পারছিলেন যে, আলোচনার নামে ইয়াহিয়া-ভুট্টো কালক্ষেপণ করছে। এভাবেই ঘটনাবহুল ১৬ থেকে ২৪ মার্চ অতিক্রম করে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করলে শেখ মুজিব বুঝতে পারেন তার অনুমানই সত্য। তিনি দ্রুত তাঁর সহকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া, আক্রান্ত হলে তাদেরকে সীমান্ত অতিক্রম এবং ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার বিস্তারিত দিক নির্দেশনা দিয়ে বিদায় করেন। কিন্তু নিজে বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে ৩২ নম্বরেই থেকে যান।
    তাঁর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তেজিত বঙ্গবন্ধু সেই রাতে পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরের অপারেটরকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক বেসামরিক বাঙালিদের উপর পাক বাহিনীর আক্রমণ এবং সেই প্রেক্ষিতে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করছেন এই মর্মে সংবাদ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালি ঐ অপারেটর বিলম্ব না করে তাঁর স্বাধীনতার বার্তা চট্টগ্রামে পৌঁছে দেন। রাত বারোটার পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তা নয় মাস অব্যাহত থাকে। এর বিপরীতে বাঙালিরা, যারা এতদিন শাসক গোষ্ঠীর দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী তারা অস্ত্র তুলে নেয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং তাঁকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হলেও নয় মাস যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি ছিলেন বাঙালির চেতনায় উপস্থিত। তিনিই ছিলেন যুদ্ধের মূল শক্তি, অনুপ্রেরণাদাতা এবং প্রাণ পুরুষ। ভয়াবহ রক্তক্ষয়, অসহনীয় দুর্ভোগের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় হয়েছে হাজার বছরের পরাধীন জাতির। বুক টান করে দাঁড়িয়েছে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরদর্পে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তার স্বপ্নের স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন এ মহানায়ক।
    যুগে যুগে অসংখ্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবী ও নেতার জন্ম হয়েছিল এই দেশে, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানই কেবল হেমিলনের বাংশীবাদকের ন্যায় এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যে মোহনায় নিয়ে এসেছিলেন, সেখানেই সাক্ষাৎ হয়েছিল স্বাধীনতার। জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। অতএব সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালিদের মুক্ত করতে এই বাংলায় প্রেরণের জন্যে। এই দেশের যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির জন্যে বারবার যেন জন্ম হয় শেখ মুজিবুর রহমানের। অন্নদা শংকর রায়ের ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়-
    ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’

লেখক : মোঃ আনোয়ার হাবিব কাজল, সাংবাদিক, সম্মানিত সদস্য, চাঁদপুর প্রেসক্লাব।