• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
  • ||
  • আর্কাইভ

করোনায় সম্মুখযোদ্ধাদের সাহসী পদক্ষেপ

জান্নাতুন নিসা

প্রকাশ:  ১০ মে ২০২০, ১৩:০৫ | আপডেট : ১০ মে ২০২০, ১৩:২০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মানুষের অযত্নে লালিত ধরিত্রী কবে-কখন-কোথায় তার অপূর্ণ স্বপ্নের কম্পিত স্পৃহায় মহামারির যাত্রা শুরু করেছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও এটুকু স্পষ্ট, আজ সে নৃশংস নৈঃশব্দের গুমোট হাওয়ায় উন্মাদ হয়েছে। বিগত শতকের ন্যায় একুশ শতকে এসে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের প্রেমাহত ধাক্কায় মানুষের জীবনযাত্রাকে স্থবির করেছে। আর পূর্ণাঙ্গ কোন সভ্যতার পতন না ঘটালেও লক্ষ মানুষের মৃত্যুর ডামাডোল বাজিয়ে বিশ্বময় ছুটে বেড়াচ্ছে মহামারি সৃষ্টিকারী নভেল করোনা ভাইরাসের পোশাকে; পৃথিবীব্যাপি আজ তার অবাধ বিচরণ। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছেই। আর এই ক্রান্তিকালে বাংলদেশেও যোদ্ধা হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ডাক্তার-নার্স সহ যতো স্বাস্থ্যকর্মী, বাংলাদেশ পুলিশ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কারণ সময় এখন যূথতার, সময় এখন মেলবন্ধনের। মহামারির দাপট ভেঙে চুরমার করে প্রাণে প্রাণে সুনন্দ-সাহস জাগাতে হবে-এই একটিই লক্ষ্য সবার। সেই সঙ্গে প্রকৃতিতে আর মানুষে, দেশে আর বিদেশে সামাজিক দুরত্বের ঐকতান বাজাতে হবে। তাহলেই কেবল মানবতা আর ধরিত্রীর প্রাণভোমরা একসঙ্গে বেঁচে যাবে, বেঁচে যাবে মানব অস্তিত্ব!

দেশজুড়ে লকডাউন কিংবা সামাজিক দুরত্বের দীর্ঘ বন্দনায় আমরা সবাই যখন ঘরমুখি। তখন ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীগণ কোভিড-১৯ পজেটিভ শত রোগীর চিকিৎসা সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ঘর-সংসার, মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান সবাইকে দূরে ঠেলে কোভিডযুদ্ধের সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করে চলেছেন দিনে কিংবা রাতে। রণাঙ্গনে যেভাবে একজন আহত সহযোদ্ধাকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড়িয়ে শুশ্রূষা করা হয়। ঠিক সেভাবেই চলছে পরিচর্চা। তবে এ যুদ্ধ কোন আণবিক বোমার কিংবা গুলি বর্ষণের নয়! এ যুদ্ধ মরণঘাতি ভাইরাস করোনার বিরুদ্ধে। যার একমাত্র অস্ত্র একসাথে দূরে থাকা। কিন্তু ডাক্তারকে করোনায় আক্রান্ত রোগীর কাছে থেকেই দিনের পর দিন তাকে সেবা দিতে হচ্ছে। জীবন বাজি রেখেই এ করোনাযুদ্ধে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন নিশ্চিত করছেন তারা। অনেকে ইতোমধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। শতাধিক ডাক্তার, অর্ধ শতকের বেশি নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্বজুড়েই চিকিৎসকদের জন্য মিলছে না পর্যাপ্ত সুরক্ষা পোশাক। অপ্রতুল ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। এত প্রতিকূলতা নিয়ে করোনাযুদ্ধে থাকা চিকিৎসকগণ থমকে যাননি বরং দিন-রাত হাসপাতালে থেকে ব্যাকূল হয়ে উঠেছেন করোনায় আক্রান্ত রোগীকে সেবা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলতে। করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ-সমরের নায়ক একেক জন ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী। আমরা যখন করোনায় আক্রান্ত রোগীকে আইসোলেশনে হস্তান্তর করে নিশ্চিন্ত তখন একজন দ্বায়িত্ববান ডাক্তার ব্যস্ত থাকছেন রোগীটির শুশ্রুষায়। সেবাই তাদের পেশার মূলমন্ত্র সেই মন্ত্র উপচে আজ তারা যোদ্ধা। এর মাঝে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তারা চিকিৎসা দিচ্ছেন না, কোথাও আবার হাসপাতাল বন্ধ। সেক্ষেত্রে বলতে হয়-বিচ্ছন্ন ঘটনার বাঁধন খুলে অধিকাংশ স্বাস্থ্যকর্মী হয়ে উঠেছে সবুজ বাংলার অদম্য যোদ্ধা। অথচ এই মানুষগুলো তো সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন তবুও তাদের মনোবল আজ তাদের যোদ্ধায় পরিণত করেছে। সেবার ব্রতে দীক্ষিত হয়ে জীবন বাজি রেখে করোনাভাইরাসকে দূরে ঠেলে সবার মুখে হাসি ফোটাতে বদ্ধ পরিকর হয়ে এগিয়ে এসেছে।

স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। যাদের বাহিনী সৃষ্টির ইতিহাসই বোধকরি নেতিবাচক। তাই আমরা সবসময়ই বাঁকা চোখেই দেখেছি তাদের। সৃষ্টির নেতিবাচক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে আজ তারা দিনের পর দিন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে মরণব্যাধি করোনার সঙ্গে বেঁধেছেন গাঁটছাড়া। সামাজিক দুরত্বের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে তারা নেমেছেন রাস্তায়। কোভিড-১৯ নিয়ে আতঙ্কিত মানুষের মধ্যকার ভয় অতিক্রম করে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ও সবাইকে সচেতন করে তুলতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তারা যতটা ধীর-স্থিরভাবে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশ পুলিশ তাদের পুলিশিং এর ক্ষেত্রে নতুন ও অভিনব বিষয়ের সংযোজনের মাধ্যমে জনবান্ধব অবস্থানে থেকে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন, গান গেয়ে পর্যন্ত মাইকিং করছেন। প্রয়োজনে ঝুঁকিও নিচ্ছেন তারা। এখন পর্যন্ত অনেকে এই কাজ করতে গিয়ে কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। তবুও মরনঘাতি এই ভাইরাসের ভয়াবহতা তাদের দায়িত্ব পালন থেকে দূরে সরাতে পারেনি। বরং দ্বিগুণ উৎসাহে তারা সাহসী হয়ে এগিয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী লোকজনের দাফনের দায়িত্বটুকু পড়েছে পুলিশের কাঁধে। শুধু তা-ই নয়, বিদেশফেরত লোকজনের হাতে কোয়ারেন্টিনের তারিখসমৃদ্ধ সিল বসানোর দায়িত্বটি নেন তারা। তাদের দৃঢ় অবস্থানই বর্তমানে আমাদের দেশে করোনার ভয়াবহতার মাত্রা কমিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে নিঃসন্দেহে! কারণ ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে জনগণ মাস্ক পরিধান করা শুরু করেছে ও করোনার ক্ষয়ক্ষতি অনুধাবন করে ঘরমুখি হয়েছে। গণজমায়েত পরিহার করে যততত্র চলাফেরা বন্ধ করার মতো বিষয় অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী। মহামারির কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থায় মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি মানবিক কাজেও এগিয়ে এসেছেন এ বাহিনীর সদস্যরা। শুধু তাই নয় দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তিদের দাফনে স্থানীয়দের বাধা অথবা অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ দাফন—এসব ঘটনা পুলিশের ব্যবস্থাপনায় সমাধানে এসেছে।

"সমরে আমরা শান্তিতে আমরা সর্বত্র আমরা দেশের তরে" এই মূলমন্ত্র কে বুকে লালন করে গড়ে উঠা আস্থার প্রতীক-বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যারা তাদের কর্মদক্ষতা ও মেধা দিয়ে কেবল দেশে নয় সমস্ত পৃথিবীতে প্রশংসা অর্জন করেছে। আর করোনা মোকাবেলার এই সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সকল জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এককথায় প্রান্তিক পর্যায়ে জনমনে সচেতনতা তৈরি, চিকিৎসা সেবা প্রদান ও লক ডাউন কার্যকর করার পাশাপাশি দুস্থ-অসহায়দের খাদ্য সহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করার কাজটি করে চলেছে সেনাবাহিনী। দেশপ্রেম আর মানবিক বোধ থেকেই মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নিজেরা বিনামূল্যে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন। শুধু কি তাই! টহলে থাকা অবস্থায় ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজনকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা, গাড়ি থামিয়ে কথা বলা এবং নির্ধারিত পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে সড়কে বের হওয়া গাড়ির চারপাশে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দেয়ার কাজটি সযত্নে করছে তারা। তারা রোদ, বৃষ্টি ও ঝড় উপেক্ষা করে সড়কে সড়কে টহল দিয়ে সাধারণ মানুষকে যেমন সতর্ক করছে, তেমনি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতেও কঠোর না হয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপে জয় করেছে দেশের মানুষের হৃদয়।

করোনাভাইরাস পরম আপনজনকে দূরে সরিয়ে দিলেও ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সেনাবাহিনী নিঃশেষে প্রাণদানে প্রস্তুত রয়েছে বীর সেনানী কিংবা নায়কের মতো। সেই সঙ্গে সাংবাদিক বা মিডিয়াকর্মী, এম্বুলেন্স চালক, লাশবাহী গাড়ীর চালক, লাশ সৎকারে এগিয়ে আসা বিভিন্ন সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী সহ অনেকেই এগিয়ে এসেছেন সাহসীকতার সঙ্গে। করোনাভয়কে দুমড়ে-মুচড়ে উচ্চে তুলে শির তাদের প্রত্যেকের একটাই শপথ-প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে সামাজিক দুরত্বের মাধ্যমে গোলকের সব প্রান্ত ছুঁয়ে হলেও মানুষকে মৃত্যু থেকে জীবনের পথে ফিরিয়ে আনতে হবে  লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারী নেত্রী এবং সাধারণ সম্পাদক, পদক্ষেপ বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ।

তথ্য সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক।

সর্বাধিক পঠিত