• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

১১ দফা দাবি নিয়ে ক্রিকেটাররা ধর্মঘটে

প্রকাশ:  ২২ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:০৪
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাপা ক্ষোভগুলো হঠাৎ করেই আগ্নেয়গিরির মতো উদ্‌গিরিত হলো। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ধর্মঘটের ডাক দিলেন ক্রিকেটাররা। গতকাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের একাডেমি মাঠে ৪৯ জন ক্রিকেটারের উপস্থিতিতে ১১ দফা দাবি তুলে ধরে এই ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। বেতন-ম্যাচ ফি বাড়ানো, বিপিএলে ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রথা ফিরিয়ে আনা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন ক্রিকেটাররা। যতদিন পর্যন্ত তাদের এই দাবি না মানবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), ততদিন পর্যন্ত ম্যাচ অনুশীলন থেকে শুরু করে ম্যাচ খেলাসহ সব ধরনের ক্রিকেটীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন সাকিব আল হাসানরা। এদিন মিরপুর একাডেমি মাঠে প্রথম সারির দশ ক্রিকেটার একেক করে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরেন মিডিয়ার সামনে। ক্রিকেটারদের এই ধর্মঘটের কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আসন্ন ভারত সফর। তবে ক্রিকেটারদের এই দাবি নিয়ে আজ বিসিবিতে বৈঠকে বসছেন নাজমুল হাসান পাপন। আশা করা হচ্ছে, ১১ দফার মধ্যে  কিছু দাবি মেনে নিয়ে ক্রিকেটারদের মাঠে ফিরিয়ে আনতে পারবেন তিনি।

এত দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এভাবে ঘটতে পারে, ক্রিকেট সংশ্নিষ্টদের কারও অনুমানেও ছিল না। বিসিবিও বুঝতে পারেনি, কবে কখন কীভাবে এবং কী থেকে এই ক্ষোভের সঞ্চার। সংবাদ সম্মেলন ডেকে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে ক্রিকেটাররা বঞ্চনার কথা জানালেন, ১১ দফা দাবি ঘোষণা করেন। ১৩ মিনিটের সংবাদ ব্রিফিংয়ে তুলে ধরা ক্রিকেটারদের দাবিগুলো খুবই যৌক্তিক মনে করা হচ্ছে। তবে দাবি-দাওয়া আদায়ের প্রক্রিয়া সঠিক নয় বলে মনে করছেন বিসিবি পরিচালদের বেশিরভাগ। পরিচালক মাহাবুবুল আনামের মতে, 'খেলোয়াড়দের দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। তারা সেটা সঠিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেলে ভালো হতো। প্রথমে সিইও, দ্বিতীয়ত ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ এবং তৃতীয়ত বিসিবি সভাপতির কাছে নিজেদের কথা জানাতে পারত। আমি মনে করি, দেশের ক্রিকেটের ক্ষতি করতে ক্রিকেটারদের আন্দোলনে নামিয়ে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এটা কারও জন্যই ভালো কিছু বয়ে আনবে না।'

ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের খবর বিশ্ব মিডিয়া গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করায় চাপে পড়ে গেছে বিসিবি। নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় দ্বিপক্ষীয় সিরিজ হওয়া নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড। বিসিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রিকেটারদের আন্দোলনে বিব্রত বোধ করছেন তারা। তবে খেলোয়াড়দের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার ব্যাপারে বা ক্রিকেটার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বসার ব্যাপারে গতকাল এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিসিবি থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন ধরেননি। তবে বোর্ডের মুখপাত্র হিসেবে সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, 'খেলোয়াড়দের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক দাবি-দাওয়া পেলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে এগুলো বিভিন্নজনের মুখে শোনা। আগে খেলোয়াড়রা লিখিত জানাক, তারপর দেখব।'

কিছু দিন ধরেই ভেতরে ভেতরে একতাবদ্ধ হচ্ছিলেন ক্রিকেটাররা। জাতীয় লিগের ম্যাচ থাকায় সবাই একসঙ্গে হতে পারেননি। রোববার লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা শেষ হওয়ায় গতকাল বিরতি ছিল। এই সুযোগে বিকেল ৩টায় ৪৯ জন ক্রিকেটার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের একাডেমি মাঠে জড়ো হন। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের প্রধান গেট দিয়ে না এসে ক্রিকেটাররা মাঠে প্রবেশ করেন ইনডোর হয়ে ক্রীড়া পল্লির পাশের ছোট গেট দিয়ে। ১৩ মিনিটের ব্রিফিংয়ে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ, তাসকিন আহমেদ, মুমিনুল হক, সৌম্য সরকার, ফরহাদ রেজা, নাঈম ইসলামরা ছিলেন। তবে ক্রিকেটারদের এই আন্দোলনে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে দেখা যায়নি।

সংবাদ ব্রিফিংয়ে ক্রিকেটারদের সংগঠন ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অব বাংলাদেশ (কোয়াব) কর্মকর্তাদের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে পাঁচ বছর আগের নিয়ম ফিরিয়ে আনার দাবি জানান মাহমুদুল্লাহ। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আগে ফ্রি দলবদল হতো। বিসিবি বর্তমান কমিটি ঢাকা লিগের ঐতিহ্য ভেঙে দিয়ে প্লেয়ার ড্রাফটে দলবদলের নিয়ম করে। এতে করে খুব কম টাকায় খেলতে বাধ্য হন ক্রিকেটাররা। পছন্দের দলও বেছে নিতে পারেন না তারা। বঙ্গবন্ধু বিপিএলকে স্বাগত জানিয়ে মুশফিকুর রহিম বলেন, আগামী বছর থেকে পুরনো নিয়মে ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক বিপিএল চান তারা। বিপিএলে বিদেশি ক্রিকেটারদের মতো দেশি ক্রিকেটারদেরও সমান পারিশ্রমিক দাবি করা হয়। পাশাপাশি গ্রেডিং পছন্দে ক্রিকেটারদের স্বাধীনতা চাওয়া হয়। আইপিএল, সিপিএলসহ বিশ্বের বড় বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে এই নিয়মে প্লেয়ার ড্রাফট হয়।

সবচেয়ে বেশি দাবি উঠে এসেছে সাকিবের দিক থেকে। জাতীয় ক্রিকেট লিগে ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি এক লাখ টাকা, বেতন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি, বিভাগীয় পর্যায়ে জিম, ইনডোর, মাঠের সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি বছরের ১২ মাস বিভাগীয় পর্যায়ে কোচ, ট্রেনার, ফিজিও রাখার দাবি জানান টাইগার অধিনায়ক। জাতীয় লিগে ক্রিকেটারদের টিএ-ডিএ বাড়ানো, এসি বাসে মাঠে যাতায়াত, জিম ও সুইমিংপুল আছে এমন হোটেল চাওয়া হয়েছে খেলোয়াড়দের জন্য। এ ছাড়া তৃতীয়, দ্বিতীয় এবং প্রথম বিভাগ লিগে বিসিবি সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের ইঙ্গিত করে সাকিব বলেন, 'আমাদের প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ এবং তৃতীয় বিভাগের মান সবাই জানি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখেছি- ম্যাচের আগেই জানা যায় কোন দল জিতবে কোন দল হারবে। আম্পায়ারিং সিদ্ধান্ত হয় পক্ষপাতিত্ব। খেলোয়াড় তুলে আনতে হলে এই জায়গাগুলোতে উন্নতি খুবই জরুরি।'

এনামুল হক জুনিয়র বলেন, কেন্দ্রীয় চুক্তিভুক্ত খেলোয়াড় অনেক কম। জাতীয় চুক্তিতে খেলোয়াড় সংখ্যা ৩০ জন করা উচিত।' বেতন বৃদ্ধির আহ্বানও জানান তিনি। ক্রিকেটার ছাড়াও গ্রাউন্ডসম্যান, দেশি কোচ, ফিজিও, ট্রেনার ও কোচিং স্টাফদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেন তামিম ইকবাল। জাতীয় লিগে আগের মতো ওয়ানডে টুর্নামেন্ট ফেরানোর দাবি তুলে ধরেন এনামুল হক বিজয়। বিপিএলের আগেও একটি টি২০ টুর্নামেন্ট চেয়েছেন তারা। নুরুল হাসান সোহান বলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের ক্যালেন্ডার রাখার কথা। বেঁধে দেওয়া সময়ে বিপিএল ও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পারিশ্রমিক পরিশোধের কথা বলেন জুনায়েদ সিদ্দিকী। বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার স্বাধীনতা দাবি করেন ফরহাদ রেজা। ক্রিকেটারদের এই আন্দোলনে নারী ক্রিকেটারদের সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান সাকিব।

নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে ক্রিকেটারদের আন্দোলন নতুন কিছু নয়। টেস্ট খেলুড়ে বহু দেশেই যৌক্তিক আন্দোলনের জন্য ধর্মঘট ডেকেছেন ক্রিকেটাররা। জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকায় আন্দোলন হয়েছে। বাংলাদেশেও আগে দু'বার আন্দোলনে নেমেছিলেন ক্রিকেটাররা। ২০০১ সালে মাঠ এবং খেলার দাবিতে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদের নেতৃত্বে প্রেসক্লাবের সামনে ক্রিকেট খেলে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। ২০০৯ সালে বিসিবির কয়েকজন পরিচালকের বিতর্কিত মন্তব্যের প্রতিবাদেও জড়ো হয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। তবে আগের দু'বারের চেয়ে এবারের আন্দোলনের গভীরতা বেশি। ক্রিকেটের সার্বিক উন্নতি চেয়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন খেলোয়াড়রা। বিসিবি পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির জানা মতে, ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের বিষয়টি এবারই প্রথম।

সর্বাধিক পঠিত