• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

ঘটনাস্থল হাজীগঞ্জের পশ্চিম রাজারগাঁও সূত্রধর বাড়ি

মায়ের হত্যাকারী স্ত্রী এখন গৌরাঙ্গের সংসার করছে

প্রকাশ:  ২১ মার্চ ২০২২, ১০:৫৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

 মায়ের হত্যাকারী স্ত্রী এখন সেই স্বামীর ঘরে সংসার করছে। স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে স্বামীর বাড়িতেই সংসার করছে শাশুড়িকে হত্যাকারী শিউলি রাণী সূত্রধর (৪০)। টানা ৬ মাস জেল খেটে বোন জামাইয়ের সহযোগিতায় জামিন পান শিউলি। জামিন পাওয়ার কিছুদিন পর ক্ষমার অযোগ্য বিষয়টি নিয়ে স্বামীর কাছে বাঁচার আকুতি নিয়ে ধর্ণা দেন শিউলি। স্বামী গৌরাঙ্গ সূত্রধর বেচারা ছোট দুটি সন্তানের কথা ভেবে সব কষ্টকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে স্ত্রীকে ঘরে তুলে নেন। এখন স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে সংসার করছেন গৌরাঙ্গ। গৌরাঙ্গ হাজীগঞ্জের রাজারগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম রাজারগাঁও গ্রামের সূত্রধর বাড়ির মৃত হরেন্দ্র সূত্রধরের একমাত্র পুত্র সন্তান। গৌরাঙ্গের দুই বোন রয়েছে, তারা বিবাহিত। গৌরাঙ্গের স্ত্রী শিউলি রাণীকে যখন তার মা মনোরমা সূত্রধরকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তখন সেই মামলার বাদী হন গৌরাঙ্গের বড় বোন পুতুল রাণী। এক কথায় গর্ভধারিণী মা হত্যার শিকার হন স্ত্রী’র হাতে, আর সেই হত্যা মামলার বাদী হন আপন বোন। এ যেন এক দক্ষিণ ভারতীয় কোনো সিনেমার গ্যাঁড়াকল কাহিনী। ঘটনাটি হাজীগঞ্জের রাজারগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম রাজারগাঁও সূত্রধর বাড়ির।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের একদিন বিকেল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বিধবা মনোরমা সূত্রধর (৬০)। একমাত্র পুত্র সন্তান, তার স্ত্রী আর এক নাতি এক নাতনিসহ ছিলো মনোরমার জীবন। সংসার জীবন হোক কিংবা পারিবারিক কোনো কারণে পুত্রবধূর সাথে সম্পর্ক ভালো ছিলো না, যার কারণে বউ-শাশুড়ি কলহ ছিলো নিত্য দিনের। সংসার জীবনে সবারই এ রকম কম-বেশি কলহ থাকে, হয়তো এমনটাই ভেবেছে সহজ-সরল গৌরাঙ্গ সূত্রধর। ঘটনার দিন সকালে কাজে যান গৌরাঙ্গ। সন্ধ্যা পর্যন্ত মা নিখোঁজ ছিলেন, সেটা কাজে থেকে খবর পাননি।  সন্ধ্যার কিছু পরে বাড়ির কিংবা প্রতিবেশীরা বাড়ির পাশের একটি গর্তে মনোরমাকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পায়। খবর পেয়ে কাজ থেকে আসেন গৌরাঙ্গ। মনোরমার লাশ পাওয়ার সাথে সাথে বাড়ির কিংবা প্রতিবেশীরা জোর দাবি করেন মনোরমাকে হত্যা করেছে পুত্রবধূ শিউলি রাণী সূত্রধর। পুরো বাড়িতে এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভিড় জমায়। লোকজন ঘরে আটকে রাখে শিউলি রাণীকে। হাজীগঞ্জ থানা থেকে পুলিশ গিয়ে সুরতহাল তৈরি করে লাশ উদ্ধারসহ শিউলি রাণীকে জিজ্ঞাবাদের জন্যে থানায় নিয়ে যায়। রাতে থানায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ নিশ্চিত হয় শাশুড়ি মনোরমাকে পূত্রবধূ শিউলি রাণীকে হত্যা করে। রাতে ভাইয়ের স্ত্রীকে একমাত্র আসামী করে মা হত্যায় মামলা দায়ের করেন মনোরমার মেয়ে পুতুল রাণী। আটক দেখানো হয় শিউলি রাণীকে আর পরের দিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন শিউলি রাণী। এর পরেই আদালত শিউলি রাণীকে জেল হাজতে প্রেরণ করে।
বেশ কয়েক মাস তদন্ত শেষে শিউলি রাণীকে আসামী করে হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ চার্জশীট দেয়। প্রায় ৬ মাস পর জামিনে আসেন শিউলি। কয়েকদিন পর পর হাজিরা দিতে হচ্ছে। সামনে হাজিরার ডেট আছে, জানিয়েছেন গৌরাঙ্গ। শাশুড়িকে পুত্রবধূ হত্যা করেছে এমন বিষয় নিয়ে ঘটনার দিন ও পরেরদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক স্ট্যাটাস আসে। যা নিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
সম্প্রতি সরজমিনে পশ্চিম রাজারগাঁও সূত্রধর বাড়িতে গেলে বাড়ির অন্য লোকজন বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি। গৌরাঙ্গ নিজ বসতঘরের পাশে টিউবওয়েলে গোসল করছেন, আর পাশে খোলা চুলায় কড়াই বসিয়ে মাছ ভাজি করছেন স্ত্রী শিউলি রাণী। ছোট ছোট সন্তান দু’টি মা-বাবার চোখের সামনে খেলা করছে। সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে চাননি কিংবা গুছিয়ে কথা বলতে পারেন নি।
অনেক কথার পর দু’জন কিছুটা স্বাভাবিক হন। এর পরেই গৌরাঙ্গ বলেন, প্রায় ৬ মাস জেল খাটার পর স্ত্রীর বাবার পরিবার জামিনে এনেছে তাদের মেয়েকে। এর পরেই সকলের কথায়, সন্তান দুটির দিকে তাকিয়ে সব কিছু মেনে নেবার চেষ্টা করি। কষ্টটা সবসময় ভুলে থাকার চেষ্টা করি। মাকে হারিয়েছেন, বড় বোন মামলার বাদী, স্ত্রী  আসামী, কী করবেন তিনি। এ এক মহা পরীক্ষা। তারপরেও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করছেন।
‘সেদিন আসলেই কী হয়েছিলো’ শিউলি রাণীর কাছে এমন বিষয় জানতে চাইলে কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে কান্না শুরু করেন। এর পরেই গৌরাঙ্গ নিজে বলেন, দাদা আসলে আমরা তেমন একটা কিছু জানি না, এ বিয়ষগুলো উকিল সাহেব বলতে পারবেন। কিন্তু এতোটাই সহজ-সরল গৌরাঙ্গ, উকিল সাহেবের ফোন নাম্বার পর্যন্ত সংগ্রহ করে দিতে পারেন নি। ‘হাজিরার তারিখ জানেন কীভাবে’ এমন প্রশ্নে গৌরাঙ্গ বলেন, মুহুরী ফোন দিলে আমরা যাই।
মনোরমা সূত্রধর হত্যা মামলার বাদী নিহতের বড় মেয়ে পুতুল রাণীকে বিয়ে দেয়া হয়েছে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায়। মুঠোফোনে পুতুল রাণী জানান, আমার মাকে হত্যা করেছে শিউলি রাণী-পুলিশ চার্জশীট দিয়েছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল, তাই মামলাটি এখন চালানো একটু দুষ্কর হয়ে পড়েছে। মুঠোফোনে স্ত্রীর সাথে সহমত পোষণ করলেন পুতুল রাণীর স্বামী।
মনোরমা সূত্রধর মামলায় পুত্রবধূ শিউি ল রাণীকে একমাত্র আসামী করে আমরা চার্জশীট দিয়েছেন বলে চাঁদপুর কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন হাজীগঞ্জ থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ। অপর এক প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, এই মামলার ময়না তদন্ত রিপোর্টে হত্যার প্রমাণ মিলেছে।