• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

পুরাণবাজার দুর্গা মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভূমিদস্যু ফরিদ দিদারের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত ॥ আটক ৫

এমন নারকীয় তা-বে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চাঁদপুরবাসী হতবাক ॥ শিক্ষামন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন

প্রকাশ:  ১৫ জুন ২০১৯, ০৯:০৯
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারে রাতের শেষভাগে অন্ধকারে ভূমিদস্যুরা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের দীর্ঘ বছরের ঐতিহ্যবাহী দুর্গা মন্দির ও কালী মন্দির। পুরাণবাজারের চিহ্নিত ভূমিদস্যু ফরিদ দিদারের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত এ ঘটনা ঘটায়। দুর্বৃত্তদের ভেঙ্গে দেয়া প্রতিমার অংশবিশেষ দেখে ঘটনাস্থলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন হিন্দু সম্প্রদায়ের শত শত ভক্ত নর-নারী। তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শত শত নারী-পুরুষ যান প্রতিবেশী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র নাছির উদ্দিন আহমেদের বাসভবনে। এরপর তারা ছুটে যান জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খানের বাসভবনে। তারা ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান। এ ঘটনায় জড়িত ফরিদ দিদারের ফাঁসির দাবিতে তারা রাস্তায় মিছিল করেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশের এ ঘটনা ঘটে চাঁদপুর পুরাণবাজার দাসপাড়া দুর্গা মন্দির ও কালী মন্দিরে। ১৩ জুন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত প্রায় ৩টার দিকে যখন সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, এ সুযোগে অত্র এলাকার প্রভাবশালী ফরিদ দিদারের নেতৃত্বে ইদ্রিছ দিদার, রাজু, মাসুদুর রহমান পরান, আতিক, আব্দুল আলীম, রাসেল, কবির, হারুনুর রশিদ বেপারী, ইয়াছিন, বাবুল সর্দারসহ প্রায় ৫০/৬০ জনের একটি দল দুর্গা মন্দির ও কালী মন্দিরে ভাংচুর চালায়। তারা মন্দিরে বিরাজমান দেবালয়ে অবস্থিত প্রতিমার স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা লুটপাট করে এবং দেবী দুর্গার প্রতিমাসহ অন্যান্য প্রতিমা খ--বিখ- করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়। তারা মন্দিরের কাঠামো ও লোহার গেট কাটার মেশিন দিয়ে কেটে গাড়িতে করে নিয়ে যায়। রাতের অন্ধকারেই গুঁড়িয়ে দেয়া হয় অর্ধশত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ দুর্গা মন্দির। এ ঘটনা চলাকালীন মন্দিরের পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার সুশীল দাস নামে এক লোক তা দেখে ফেলে।  ঘটনাটি দেখে তার সন্দেহ হওয়ায় তিনি তাদের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা তাকে ঘটনা সম্পর্কে কোনো কথা না বলতে ধমক দেয়। কিন্তু তিনি তাদের কথা না শুনে ডাক-চিৎকার দিলে সন্ত্রাসীরা তার ওপর হামলা চালায়। তাদের দায়ের কোপে সুশীল দাসসহ আরো ১ জন মারাত্মকভাবে আহত হন।
মুহূর্তের মধ্যে ঘটনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। তারা ঘটনায় জড়িতদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের মারমুখী আচরণ আর দেশীয় অস্ত্রের কাছে নিরীহ হিন্দু পরিবারের সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়ে। তারা তাৎক্ষণিক পুলিশসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলে ভোর প্রায় সাড়ে ৪টার সময় চাঁদপুর মডেল থানার সাব ইন্সপেক্টর পলাশ বড়ুয়ার নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। তারা ঘটনাস্থল থেকে ঘটনার নেতৃত্বদানকারী ফরিদ দিদার, আব্দুল আলীম, রাজু, আতিক ও ইদ্রিছ দিদারসহ ৫ জনকে আটক করেন। এরই মধ্যে ঘটনার ভয়াবহতায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে আশপাশের এলাকার শত শত হিন্দু নর-নারী। তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় মিছিল বের করে। তাদের বিরাট একটি অংশ ছুটে যায় পৌর মেয়রসহ জেলা প্রশাসকের বাসভবনে। তারা ঘটনার সুষ্ঠু বিচারসহ মূলহোতা ফরিদ দিদার ও ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ফাঁসি দাবি করেন। অপরদিকে পুলিশ, পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ ঐক্য পরিষদ নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে এলাকায় তল্লাশি চালায় মন্দিরের ভেঙ্গে নিয়ে যাওয়া স্থাপনা এবং প্রতিমা উদ্ধার করার জন্যে। তারা অনেক খোঁজাখুঁজির পর পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের পূর্ব জাফরাবাদ আলী গাজী ও নূরু গাজী, বাবুল সর্দারের বাড়ি থেকে মন্দিরের টিন, বেড়া, সাইনবোর্ড, লোহার বড় গেইট, সিমেন্টের পালাসহ বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করে। একই সময় মন্দির সংলগ্ন লাইসিয়াম কিন্ডারগার্টেনের ভেতর থেকে লোহা কাটার মেশিন, ড্রিল মেশিন, বড় হামার, গাইতি, হাতুড়া, শাবল ও কারেন্টের তার উদ্ধার করা হয়। যা ব্যাবহার করা হয়েছিল মন্দিরের স্থাপনা ভাঙ্গাসহ লোহার গেইট ভাঙতে। অপরাধীরা অপকর্মের কাজে কীভাবে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করার সুযোগ পেলো তা ভেবে অনেকেই অবাক হয়েছেন। অনেকেই বলছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এর সাথে জড়িত রয়েছেন। অপরদিকে ভাঙ্গারপুল এলাকার কুচুরীপানাপূর্ণ খাল খেকে উদ্ধার করা হয় দেবী দুর্গা প্রতিমাসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর খ--বিখ- অংশ। যা দেখে ধর্মপ্রাণ হিন্দু সমাজের অনেকেই আবেগপূর্ণ হয়ে ওঠেন, তাদের মাঝে অনেকেই চোখের জল ছেড়ে দিয়ে ২ হাত তুলে ঈশ্বরের দরবারে বিচার দাবি করেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বিচরণ ভূমি চাঁদপুরে এহেন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষও হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তারাও ঘটনার বিচার দাবি করেন। বিপুল সংখ্যক মুসলমানও ঘটনাস্থলে এসে হতবাক হয়ে যান। অনেকেই মনে করেন সম্পত্তিগত বিরোধ যদি থেকেই থাকে তাহলে তা আইনের মাধ্যমে মীমাংসা না করে রাতের অন্ধকারে দেবালয় ভেঙ্গে যে ন্যাক্কারজনক কাজ করা হয়েছে তা ক্ষমার অযোগ্য। ঘটনার সাথে জড়িতদের সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত বলেও তারা দাবি জানান। তারা মনে করেন যারা ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আঘাত দেয় তারা সকলের কাছেই ঘৃণিত অপরাধী। এ সকল অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত।
সকাল ৮টায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান, পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বিপিএম, পিপিএমসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ। তারা উত্তেজিত জনতাকে শান্ত থাকার কথা বলেন এবং প্রশাসনের উপর আস্থা রাখার অনুরোধ জানান। তারা ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ৫জনকে আটক করার সংবাদ জানিয়ে বলেন, যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের কেউই ছাড় পাবে না। আপনারা আইনের প্রতি বিশ^¦াস হারাবেন না। আপনাদের অশান্ত হওয়ার সুযোগে কোনো দুষ্কৃতকারী আপনাদের মধ্যে ঢুকে বড় ধরনের অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে। তাই আপনারা কেউ উত্তেজিত হবেন না। এভাবে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত রাখার জন্যে জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র রায়, সাধারণ সম্পাদক তমাল কুমার ঘোষ, জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডঃ রণজিৎ রায় চৌধুরীও কার্যকর  ভূমিকা রাখেন। এ সময় এলাকার পৌর কাউন্সিলর আঃ লতিফ গাজী, জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সহ- সভাপতি প-িত নরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিমল চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক গোপাল সাহা, জেলা সদস্য দুলাল দাস, মৃনাল কান্তি দাস, সদর উপজেলা পূজা পরিষদের সভাপতি সুশীল সাহা, সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্মণ চন্দ্র সূত্রধর, দাস পাড়া দুর্গা মন্দিরের সভাপতি প্রদীপ কুমার দাস, সাধারণ সম্পাদক গৌতম দাস, দাসপাড়া কালী মন্দিরের সভাপতি স্বপন কুমার দাস, সাধারণ সম্পাদক বিকাশ কুমার দাসসহ পূজা পরিষদ ও ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার সংবাদ পেয়ে পরে পর্যায়ক্রমে পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নাছির উদ্দিন আহম্মেদ, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ¦ ওচমান গনি পাটওয়ারী, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি শহীদ পাটোয়ারী, সাংগঠনিক সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্লাহ, জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী মাঝিসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দকে ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের আশ^াস প্রদান করেন।
এদিকে চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি গতকাল ঢাকা থেকে চাঁদপুর আসার পরপরই দুপুুর ২টায় তিনি ঘটনাস্থলে যান। তাঁকে কাছে পেয়ে হিন্দু নারীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের এ অবস্থা দেখে ডাঃ দীপু মনিও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি আশ^াস দেন কোনো অবস্থাতেই অপরাধীরা ছাড় পাবে না। তিনি নির্ভয়ে তাদেরকে পূজা অর্চনা করার আশ^াস প্রদান করেন। তিনি বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেনো আইনের হাত থেকে তারা মুক্তি পাবে না। বিচার তাদের হবেই।
এ সময় জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান, পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বিপিএম, পিপিএম, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পৌর মেয়র নাছির উদ্দিন আহম্মেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল, সহ-সভাপতি ডাঃ জে আর ওয়াদুদ টিপু, সাংগঠনিক সম্পাদক তাফাজ্জল হোসেন এসডু পাটওয়ারী, ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডঃ জাহিদুল ইসলাম নোমান, সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আইউব আলী বেপারী, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান টুটুল, যুগ্ম আহ্বায়ক পৌর কাউন্সিলর মোঃ আলী মাঝি, জেলা পূজা পরিষদের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র রায়, সাধারণ সম্পাদক তমাল কুমার ঘোষ, জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টন ঐক্য পরিষদের সভাপতি অ্যডঃ বিনয় ভূষণ মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডঃ রঞ্জিত রায় চৌধুরী, সদস্য মুক্তিযোদ্ধা অজিত সাহা, মুক্তিযোদ্ধা বাসুদেব মজুমদার, চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মাঈনুল ইসলাম কিশোর, জেলা মহিলা পরিষদের সভানেত্রী লীলা মজুমদার, সহ-সভাপতি বুলি চক্রবর্তীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পূজা পরিষদ ও ঐক্য পরিষদ নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।