• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

কালের সাক্ষী দুলাল রাজা ও থানা বিবির দিঘি

প্রকাশ:  ০৪ জুন ২০২৩, ০৯:২০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

কচুয়া উপজেলার পালগিরি একটি বহুল আলোচিত প্রাচীন জনপদ। এই গ্রামে অনেক জ্ঞানীগুণী লোকের জন্ম। এই গ্রামে  দুলাল রাজা ও থানা বিবির দিঘি অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। উপজেলা সদর হতে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কচুয়া-কালিয়াপাড়া সড়ক সংলগ্ন উত্তর পাশে পালগিরি গ্রামের অবস্থান। এই গ্রামে দুলাল রাজা ও থানা বিবির দিঘি রয়েছে।
দেশের বহু প্রাচীন জনপদকে ঘিরে রয়েছে কিংবদন্তিমূলক গল্প-কাহিনী। এসব গল্প-কাহিনী শোনার জন্যে মানুষ চরম কৌতূহল বোধ করে থাকে। বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের লোকজনরা আজও চরম আগ্রহ ভরে পৌরাণিক কাহিনী শুনে থাকে। দুই বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পালগিরি গ্রামে প্রায় ৭ হাজার লোক বাস করে। উঁচু ভূমি ও প্রায় সমতল ভূমি বিশিষ্ট এ গ্রামের পথ ঘাট বেশ উন্নত। হরেক রকম প্রাচীন বৃক্ষ-লতা দিয়ে ঘেরা ছায়া সুনিবিড় এ গ্রামের সৌন্দর্য সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে, পালরাজাদের আমলে নদী পথে এ প্রশস্ত স্থান (পালগিরি গ্রাম অংশ) ব্যবসায়ীদের আড়তে পরিণত হবার কারণে এ গ্রামের নামকরণ পালগিরি হয়ে থাকতে পারে। প্রাচীন বাংলার প্রথানুযায়ী কথিত এ নদীর পাড়েই একটি ছোট জনবসতি এলাকা (পালগিরি গ্রাম) কান্দিরপাড় নামে লোকজনের নিকট পরিচিত। পালগিরি গ্রামকে ঘিরে যেমনি রয়েছে অনেক অনেক কিংবদন্তি, তেমনি সেসব কাহিনীর প্রেক্ষাপটে কিছু প্রতীকী সাক্ষীর অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান রয়েছে। ফলে কিংবদন্তির কাহিনীগুলো আজও পরম সমাদরে লোকমুখে আলোচিত হচ্ছে। এ গ্রামের বিভিন্ন স্মৃতি চিহ্ন আবিষ্কার থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ৭৬-এর মন্বন্তরে (বাংলা ১১৭৬ সন) কিংবা সমসাময়িক কালে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভৌগোলিক এবং সামাজিক      প্রকৃতি-পরিবেশ পাল্টে যায়। বর্তমানে এ গ্রামের অধিবাসীদের পূর্ব পুরুষরা অন্যত্র থেকে এ গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে। এ থেকে এক সময়ে পালগিরি গ্রাম-এলাকা যে জনশূন্য হয়ে পড়েছিল সে ধারণা লাভ করা যায়।
পালগিরি গ্রামে রয়েছে কয়েকটি প্রাচীন দিঘি, একটি প্রাচীন মসজিদ, স্থানে স্থানে ইটের ডিবি, পুরানো ইমারতের ভগ্নাবশেষ, প্রাচীন আমলের তৈরি মাটির বাসন কোসন। তাছাড়া বিভিন্ন সময় এ এলাকায় মাটি ও পুকুর খনন করে পাওয়া গেছে ঘড়া (ঘটকি) ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা, স্বর্ণালঙ্কার, নৌকার বৈঠা, দীর্ঘদেহী মানুষের কংকাল, শিবের দশভূজা মূর্তি (কুমিল্লা জাদুঘরে রক্ষিত) এবং গভীর নলকূপ বসাতে গিয়ে ২৪০ ফুট নিচে প্রাপ্ত হলদে বর্ণের গাছের টুকরা।
জনশ্রুতি রয়েছে, এককালে দুলাল রাজা নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি এ গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। লোক মুখে তিনি রাজা হিসেবেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। দুলাল রাজা তাঁর অনিন্দ্য সুন্দরী ভাগ্নে বধূ থানা বিবির রূপের মোহে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। এতে বুদ্ধিমতি রূপের রাণী থানা বিবি শর্ত আরোপ করেন যে, তিনি ও দুলাল রাজা একই রাতে পৃথক পৃথক দুটি দিঘি খননের কাজ সম্পন্ন করবে। দুলাল রাজার দিঘিটি হবে থানা বিবির দিঘির তুলনায় বড় এবং থানা বিবির দিঘি খননের পূর্বেই দুলাল রাজার দিঘি খননের কাজ সমাপ্ত করতে হবে। এ পরীক্ষায় দুলাল রাজা জয়ী হলে তিনি থানা বিবিকে বিয়ে করতে পারবেন। তবে ব্যর্থ হলে দুলাল রাজাকে সূর্যোদয়ের পূর্বেই দেশত্যাগ করতে হবে। শর্তানুযায়ী দুজন একই রাতে একই সময়ে দিঘি খননের কাজে লেগে যান। থানা বিবির দিঘি খননের কাজ রাতের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। কিন্তু দুলাল রাজার দিঘির তিনপাড় বাঁধা শেষে উত্তর পাড় বাঁধা শুরু হলে থানা বিবির চাতুরিতে তারই পোষা মোরগ রাত শেষ হওয়ার আগেই ডাক দিতে থাকে। ফলে উত্তর পাড় আর বাঁধা হয়নি। দুলাল রাজার দিঘির কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। পরাজিত দুলাল রাজা সূর্যোদয়ের পূর্বেই দেশত্যাগ করেন। পরবর্তীতে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও দুলাল রাজার সন্ধান মিলেনি। কেউ বলেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ৩ একর আয়তন বিশিষ্ট থানা বিবির দিঘিটি এখনও গ্রামের দক্ষিণাংশে এবং ২০ একর আয়তন বিশিষ্ট দুলাল রাজার দিঘি উত্তর-পূর্বাংশে। দুই দিঘির দূরত্ব প্রায় ৫শ’ মিটার। লোকমুখে শোনা যায়, আগের দিনের লোকজন বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে (বিয়ে, মেজবানি ইত্যাদি) তাদের দরকার মতো থালা-বাসন চাইলে থানা বিবির দিঘিতে নৌকায় ভেসে উঠতো। ৭০/৭৫ বছর পূর্বে কেউ একজন নাকি কিছু থালাবাসন চুরি করে রেখে দিয়েছিল। আর সেই থেকেই পিতলের এসব     থালা-বাসন ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। আজও অনেকেই বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে থানা বিবির দিঘিতে দুধ, কলা ভোগ দেয়াসহ দিঘির পানি পান করেন। এতে কেউ কেউ উপকার পাওয়ার কথা দাবি করছেন।
বর্তমানে স্থানীয়রা দিঘির বিভিন্ন অংশ বন্দোবস্ত নিয়ে বিভিন্ন ফসলাদি ফলানো সহ মাছ চাষ করে আসছে। এ দিঘির সংস্কার কাজ করে পরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ করলে বছরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন সম্ভব।

 

সর্বাধিক পঠিত