• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

অসহায়ের সহায় গ্রাম আদালত

২০ টাকা ফি দিয়ে সত্তর হাজার টাকা ফেরত পেলেন আরিফা

প্রকাশ:  ১৬ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:৪০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

আবেদনকারীর পরিচিতি : মোসাম্মৎ আরিফা আক্তার। বয়স আনুমানিক ৩৫। গ্রাম : সোনাকান্দা, ইউনিয়ন : দৌলতপুর, উপজেলা : দাউদকান্দি, জেলা : কুমিল্লা। ৪ বোন ও বাবা মাসহ মোট ৬ জনের সংসার। পেশায় কিন্ডারগার্টেনের স্কুল শিক্ষক। তাঁর বাবা দিনমজুর ও মা গৃহিণী। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি টিউশনি করেন। তার মা বাড়ির কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন হাতের কাজ করে থাকেন। যেমন, কাঁথা সেলাই, মোড়া, কুলা ও ডালা তৈরি ইত্যাদি।
প্রতিবাদীর পরিচিতি : মোঃ সুফি আহাম্মদ (রনি), গ্রাম : পাটন, ইউনিয়ন : নায়েরগাঁও দক্ষিণ, উপজেলা : মতলব দক্ষিণ, জেলা : চাঁদপুর। তিনি সৌদি-আরব প্রবাসী।
বিরোধের সূত্রপাত : আবেদনকারী ও প্রতিবাদী সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন। আবেদনকারী মোসাম্মৎ আরিফা আক্তার প্রায় ২ বছর পূর্বে প্রতিবাদী মোঃ সুফি আহাম্মদ (রনি)কে তার বাবাকে বিদেশ নেয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। রনি তাকে বলেন যে, বিদেশ যেতে হলে প্রথমে পাসপোর্ট করতে হবে। আরিফা তার কথায় রাজি হয়ে বাবার জন্য পাসপোর্ট করে রনিকে জানায়। রনি সৌদি-আরব থেকে আরিফাকে বিশ হাজার টাকা দিতে বলে। রনির কথা মতো আরিফা বিশ হাজার টাকা দেয়। এরপর রনি ভিসা প্রস্তুত হয়েছে বলে আরো পঞ্চাশ হাজার টাকা চান। তার বাবাকে কিছু দিনের মধ্যেই বিদেশে নিয়ে যাবে বলে তাকে জানায়। আরিফা রনির কথা মতো আরো পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়। কিন্তু রনি তার বাবাকে বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে টাল-বাহানা শুরু করে। এভাবে প্রায় ২ বছর পার হয়ে যায়। বিদেশে নিচ্ছেও না, আবার টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। এরপর রনি গত ০৪/১১/২০১৮ তারিখে বাংলাদেশে আসে। আরিফা বিষয়টি জানতে পেরে তার বাবাকে সাথে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রনির সঙ্গে দেখা করে তার টাকা ফেরৎ চান। কিন্তু রনি টাকা ফেরৎ দিতে অস্বীকার করেন।
গ্রাম আদালতের ধারণা লাভ : বাংলাদেশ সরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপি-এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মূল ভিত্তি হচ্ছে : গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) এবং গ্রাম আদালত বিধিমালা ২০১৬। এ আইন বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নারী, দরিদ্র ও অসহায় মানুষ অল্পসময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে সঠিক বিচার পাবেন। এ প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, সচিব ও গ্রাম পুলিশদের গ্রাম আদালত বিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গ্রাম আদালত বিষয়ক উঠান-সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আরিফা আক্তার বিষয়টি রনির সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের এক ইউপি সদস্যকে জানান। বিষয়টি শুনে ইউপি সদস্য আরিফাকে ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালিত গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেন। আরিফা উক্ত ইউপি সদস্যের মাধ্যমে আরো জানতে পারেন, তাদের ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং সেখানে মামলা করলে ন্যায়-বিচার পাওয়া যায়। মামলার জন্য মাত্র ১০ টাকা অথবা ২০ টাকা ফি দিতে হয়। এই আদালতে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করা লাগে না। মামলার খরচ খুবই কম হওয়ায় মোসাম্মৎ আরিফা আক্তার রনির ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে সরাসরি গ্রাম আদালতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন।
গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের : ইউপি সদস্যের কথা মতো আরিফা ৫/১২/২০১৮ তারিখে রনির সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে আসেন এবং গ্রাম আদালত সহকারী রিমা আক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। আরিফা তাকে বিষয়টি বিস্তারিত বলেন। বিষয়টি গ্রাম আদালতের আওতাভূক্ত বিধায় রিমা আক্তার তাকে গ্রাম আদালতে অভিযোগ দায়েরের পরামর্শ দেন। ওই দিনই আরিফা আক্তার ২০ টাকা ফি প্রদান করে গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করেন।
গ্রাম আদালতের বিচার প্রক্রিয়া : আদালত সহকারী রিমা আক্তার দাখিলকৃত অভিযোগটি সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুস সালাম মৃধা অভিযোগটি গুরুত্ব সহকারে দেখেন। আদালত সহকারীকে ১১/১২/২০১৮ তারিখে দিন ধার্য করে প্রতিবাদীর প্রতি সমন জারী ও আবেদনকারীকে মামলার স্লিপ দেয়ার নির্দেশ দেন। আদালত সহকারী যথানিয়মে গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে সমন জারি ও মামলার স্লিপ প্রদান করেন।
নির্ধারিত তারিখে আবেদনকারী ও প্রতিবাদী আদালতে উপস্থিত হন এবং হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। এরপর তারা উভয়ই ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুস সালাম মৃধার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিবাদী চেয়ারম্যানের কাছে সত্তর হাজার টাকা নেয়া কথা অকপটে স্বীকার করেন এবং ওইদিনই চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বিশ হাজার টাকা আবেদনকারীকে প্রদান করেন। আর বাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রদানের জন্য চেয়ারম্যানের নিকট ৬ দিনের সময় প্রার্থনা করেন। চেয়ারম্যান প্রতিবাদীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে এবং আবেদনকারীর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে তার জন্য মোট ৬ দিনের সময় মঞ্জুর করেন।
৬ দিন পর ১৭/১২/২০১৮ তারিখে প্রতিবাদী মোঃ সুফি আহাম্মদ (রনি) মামলার দাবীকৃত অবশিষ্ট পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে আসেন এবং চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে আবেদনকারী মোসাম্মৎ আরিফা আক্তারকে বুঝিয়ে দেন। এরপর উভয়ে আদালতের নির্ধারিত আপোষনামা ফরমে স্বাক্ষর করেন। এভাবে সংঘঠিত অপরাধ ইউপি চেয়ারম্যানের সামনে স্বীকার করা ও শতভাগ দাবি মিটিয়ে দেয়ায় মামলাটি গ্রাম আদালত বিধিমালা ২০১৬-এর বিধি ৩১ অনুযায়ী নিষ্পত্তি হয় এবং প্রয়োজনীয় সকল নথি সংরক্ষণের আদেশ তামিল হয়।
আবেদনকারীর প্রতিক্রিয়া : আবেদনকারী মোসাম্মৎ আরিফা আক্তার স্বল্প সময়ে এবং অল্প খরচে সহজেই ন্যায়-বিচার পেয়ে গ্রাম আদালতের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, গ্রাম আদালত থাকায় আমি খুব সহজে আমার পাওনা টাকা আদায় করতে পেরেছি। আমি কখনো ভাবিনি যে, আমার ইউনিয়নের বাইরে অন্য ইউনিয়নে মামলা দায়ের করে এমন ন্যায়-বিচার পাব। একজন নারী হিসেবে আমি যখন ওই গ্রাম আদালতে যাই তখন সেখানেও আমি আদালত সহকারী হিসেবে একজন নারীকে পাই যা আমাকে আরো আশাবাদী করে তোলে। শুধু তাই নয়, আমি আদালত সহকারীর কাছে আমার বিরোধের বিষয়টি অতি স্বাচ্ছন্দ্যে বলি এবং তিনিও মনযোগ সহকারে আমার কথা শোনেন। তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যেন গ্রাম আদালত স্থায়ীভাবে এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
বিচারিক-সেবা মূল্যায়ন : হিসেব অনুযায়ী এক দিনের মধ্যেই মামলাটি নিষ্পত্তি হয় এবং ৬ দিনের মধ্যে মামলার আদেশ শতভাগ বাস্তবায়িত হয়। মামলাটির জন্য আবেদনকারীকে মোট ৩ বার আদালতে আসতে হয়েছে। এরমধ্যে মামলা দায়েরের জন্য একদিন, মামলায় হাজিরার জন্য একদিন এবং দাবিকৃত টাকা গ্রহণের জন্য আরো একদিন তাকে আদালতে আসতে হয়েছে। বিচার পাবার জন্য মামলার ফি বাবদ আবেদনকারীর খরচ হয়েছে মাত্র ২০ (বিশ) টাকা যেহেতু মামলাটির ধরন দেওয়ানী প্রকৃতির। তাই বলা যায় যে, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য অতি সহজে ও স্বল্প সময়ে ন্যায়-বিচার পাওয়ার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে চাঁদপুরের গ্রাম আদালতগুলো।
 

 

সর্বাধিক পঠিত