• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

সাহিত্য-সংস্কৃতি এক ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধন

প্রকাশ:  ১৫ মে ২০২৫, ১১:৫৭
উজ্জ্বল হোসাইন
প্রিন্ট

মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতি মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই দুইয়ের সম্পর্ক এতটাই নিবিড় ও আন্তঃসম্পর্কিত যে, একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করাই কঠিন। সাহিত্য একটি সমাজের চিন্তা, চেতনা, অনুভব ও কল্পনার রূপান্তর যেখানে সংস্কৃতি হল সেই সমাজের জীবনধারা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও অভ্যাসের প্রতিফলন। এই প্রবন্ধে আমরা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, একে অপরকে প্রভাবিত করার রূপ, এবং সমাজে এদের অবদান বিশ্লেষণ করব।
সাহিত্য শব্দের অর্থ ‘সাহিত্যের সৃষ্টি’ যা ভাষার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। সাহিত্য কেবল কল্পনার ফসল নয়, এটি বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবিও বটে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। যা সময়ের পরিবর্তন, মানুষের ভাবনা, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে।
সংস্কৃতি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ ‘গঠন করা’, ‘পরিশোধন করা’। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনযাপনের ধারা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, আচার-অনুষ্ঠান, ভাষা, শিল্পকলা সব মিলিয়েই গঠিত হয় সংস্কৃতি। এটি সময়ের সঙ্গে রূপান্তরিত হলেও এর শিকড় থাকে অতীত অভিজ্ঞতায়।
সাহিত্য সংস্কৃতির অনুবাদক। সাহিত্য সংস্কৃতিকে চিত্রিত করে, বিশ্লেষণ করে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা সঞ্চারিত করে। অন্যদিকে, সংস্কৃতি সাহিত্যের রসদ জোগায় তার বিষয়বস্তু, পটভূমি ও চরিত্রের মাধ্যমে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি একে অপরকে পুষ্ট করে।
যেকোনো কালে রচিত সাহিত্য সেই সময়ের সংস্কৃতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট ও জীবনের প্রতিফলন। যেমন মঙ্গলকাব্য বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে। এতে কৃষি নির্ভর সমাজের দেব-দেবী পূজার আচার, মানুষের বিশ্বাস ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য আধুনিক বাঙালি মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর গান, কবিতা, উপন্যাসে সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক রূপ ফুটে উঠেছে। সাহিত্য রচনায় লেখক তার চারপাশের সংস্কৃতি থেকে উপাদান গ্রহণ করেন জীবনধারা, ভাষা, প্রবাদ-প্রবচন, লোক কাহিনি, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো সাহিত্যকে সময়-প্রাসঙ্গিক করে তোলে।
সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ভাষা সাহিত্যের বাহক। ভিন্ন অঞ্চলের সাহিত্য তাদের স্বতন্ত্র ভাষা ও উপভাষার মাধ্যমেই এক ভিন্ন সাংস্কৃতিক রঙ বহন করে। যেমন বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের সাহিত্য ঢাকার সাহিত্যের চেয়ে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আলাদা।
ইতিহাসের ধারায় সাহিত্য-সংস্কৃতি-সাহিত্য ও সংস্কৃতি কালের স্রোতে কিভাবে একে অপরকে প্রভাবিত করেছে, তা ইতিহাসের পাতা ও সাহিত্যচর্চায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। পৌরাণিক কাহিনি, বেদ, মহাভারত ও রামায়ণ শুধু ধর্মীয় নয়, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এসব গ্রন্থ ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড় গেঁথে দিয়েছে। ভক্তি কাব্যধারার (চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, মীরাবাঈ) সাহিত্য সমাজে একটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক চেতনার সঞ্চার করেছে। ইসলামী রেনেসাঁ ও সুফি সাহিত্যে নতুন ধ্যান-ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্গ জবহধরংংধহপব-এর সময় সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবজাগরণ ঘটে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি ব্যক্তিত্ব সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে নতুন সমাজচিন্তা ও সংস্কৃতির জন্ম দেন।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, সঞ্জীব, জীবনানন্দ, সুনীল, শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ ও সমকালীন লেখকগণ তাঁদের সাহিত্যে সমকালীন সংস্কৃতির বিবর্তন তুলে ধরেছেন। গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে সাহিত্যেও পরিবর্তন এসেছে—নতুন বিষয়, প্রযুক্তি, নগর-জীবনের টানাপোড়েন উঠে এসেছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেবল শিল্প বা রুচির বিষয় নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনেরও হাতিয়ার। এরা মানুষের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা গঠনে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহিত্যে দেশপ্রেম, সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ লেখকের সাহিত্য জনগণের চেতনাকে উজ্জীবিত করে।
সাহিত্যে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের চিত্রায়নের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখে। বিশ্বসাহিত্যে টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি কিংবা মার্কেজের রচনাগুলি মানবিক সংস্কৃতিকে উন্মোচন করে। একটি জাতির সাহিত্য তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে, অন্যদিকে সংস্কৃতি তাকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে। সাহিত্য সংস্কৃতির ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করে, যা একটি জাতিকে তার ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত রাখে।
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নতুনভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ডিজিটাল যুগে সাহিত্য, ই-বুক, অডিওবুক, ব্লগ, সোস্যাল মিডিয়ায় সাহিত্য এখন সহজলভ্য। যদিও এই মাধ্যম সাহিত্যকে গণমুখী করছে, তবুও দ্রুততার যুগে গভীর পাঠের অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে, যা সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য হুমকি।
বিশ্বায়নের ফলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধিপত্য বাড়ছে, যার প্রভাবে স্থানীয় ভাষা, পোশাক, খাদ্য, রীতিনীতি প্রভৃতি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাহিত্য এ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আত্মপরিচয়ের রক্ষাকবচ হতে পারে। স্থানীয় সাহিত্যচর্চার প্রসার অঞ্চলভিত্তিক সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রসারে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ভাষার বিকাশে সাহিত্যচর্চা-সাহিত্যই ভাষাকে জীবিত রাখে। তাই মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা ও পাঠ উৎসাহিত করতে হবে।
নতুন মাধ্যমের সদ্ব্যবহার করতে হবে। ডিজিটাল মাধ্যমে সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে। সাহিত্য ফেস্টিভ্যাল, অনলাইন ম্যাগাজিন, অডিওভিত্তিক সাহিত্যচর্চা আরও জনপ্রিয় করা যেতে পারে। ব্যাপক পরিসরে সাংস্কৃতিক সংলাপ করা যেতে পারে। ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সাহিত্য যেমন সমৃদ্ধ হয়, তেমনি বহুত্ববাদী সমাজে সহাবস্থানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেবল সময়ের সঙ্গে বদলায়নি বরং নতুন বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে অভিযোজিত করেছে। এই অভিযোজন কখনো ভাষার রূপে, কখনো গল্প বলার ধরনে, কখনও কখনো সময়ের ব্যবধানে, কখনো বা বিষয়ের বিন্যাসে প্রকাশ পেয়েছে। লোকসাহিত্য ছিলো মৌখিক সংস্কৃতির বাহক পল্লিগাথা, পালাগান, লোক কবিতা ইত্যাদিতে আমরা সংস্কৃতির জীবন্ত চিত্র পাই। যেমন-ভাটিয়ালি গান নদীমাতৃক বাংলার সংস্কৃতি ও পেশাজীবনের প্রতিচ্ছবি। পরবর্তীকালে এই মৌখিক ধারা লিখিত সাহিত্যে রূপান্তরিত হয়ে আধুনিক পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক সাহিত্যে শহর-গ্রামের দ্বন্দ্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। একদিকে গ্রামীণ সংস্কৃতির বিলুপ্তির ভয়, অন্যদিকে শহুরে জীবনযাত্রার জটিলতা—এই দুই বিপরীত সংস্কৃতি সাহিত্যে এক নতুন ধরনের দ্বন্দ্ব ও উপলব্ধি সৃষ্টি করেছে। যেমন-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি, সামাজিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সংগ্রাম অসাধারণভাবে চিত্রিত হয়েছে। আবার সমরেশ মজুমদার বা সেলিনা হোসেনের রচনায় শহর-গ্রামের পারস্পরিক টানা-পোড়েন পাওয়া যায়। সাহিত্য ও সংস্কৃতির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে নারীর অবস্থান ও তাঁর অভিজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহিত্যচর্চা এক ভিন্ন সাংস্কৃতিক বোধ তৈরি করে। মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় আদিবাসী নারী ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সংগ্রাম উঠে এসেছে। তসলিমা নাসরিন বা সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম একটি সাহসী সংস্কৃতির উদাহরণ।
নারী যখন সাহিত্যচর্চায় সক্রিয় হন, তখন তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও জীবনযাপন একটি নতুন সাংস্কৃতিক পরিসর সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রযুক্তির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ইত্যাদি নতুন মাধ্যমগুলো সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে। আজকাল অনেকে ইনস্টাগ্রামে পোয়েট্রি ব্লগিং করছেন, যেখানে মেট্রোপলিটন জীবনের অনুভূতি, প্রেম, বিচ্ছেদ—সবই ছন্দবদ্ধভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। অনেক সাহিত্যিক ডিজিটাল নাটক বা স্ক্রিনপ্লের মাধ্যমে সমকালীন সংস্কৃতির টানাপোড়েন ফুটিয়ে তুলছেন। এটি প্রমাণ করে, সাহিত্যের রূপ বদলালেও তার মূল কাজ সংস্কৃতির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যেও সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব উপন্যাসে লাতিন আমেরিকার ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি মিশে গিয়ে সাহিত্যকে মহাকাব্যে পরিণত করেছে। চিনুয়া আচেবের ঞযরহমং ঋধষষ অঢ়ধৎঃ আফ্রিকান সমাজ ও ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক সংঘাতকে চিত্রিত করেছে। হারুকি মুরাকামি তাঁর জাপানি সামাজিক বাস্তবতা ও সংস্কৃতি এক বিমূর্ত ও আধুনিক রূপে উপস্থাপন করেন। এসব সাহিত্যকর্ম প্রমাণ করে যে, সাহিত্য বিভিন্ন জাতির সাংস্কৃতিক স্মৃতি ধারণ করে রাখে এবং বিশ্বকে সেই জাতির অন্তর্জগতের সঙ্গে পরিচিত করায়। বয়সভিত্তিক শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায় সংস্কৃতির বীজ রোপণ করা জরুরি।
শিশু-কিশোর সাহিত্য তাদের ভেতরে নৈতিকতা, সহানুভূতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় গঠনে সাহায্য করে। গল্পের মাধ্যমে শিশুরা দেশের ইতিহাস, লোক কাহিনি, মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে জানতে পারে। নাটক, কবিতা আবৃত্তি, বইপড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে তারা সাহিত্যিক রুচি ও সাংস্কৃতিক পরিশীলন লাভ করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে নিজের শেকড় ভুলে না যায়, তার জন্য স্কুল-কলেজে সাহিত্য ও সংস্কৃতির কার্যকর মেলবন্ধন অপরিহার্য।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিএই দুই একে অপরের অবিচ্ছেদ্য আত্মা ও শরীর। সাহিত্য সংস্কৃতির ভাষ্যকার, আবার সংস্কৃতি সাহিত্যের প্রাণরস। একটি জাতির জীবনচর্চা, স্বপ্ন, সংকট, সংগ্রাম, সৃষ্টিশীলতা ও আত্মপরিচয়—সব কিছুই এই দুইয়ের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে। আজকের দিনে যখন প্রযুক্তি, বৈশ্বিক চাপ এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে, তখন সাহিত্য-সংস্কৃতির শক্তি আমাদের আত্মপরিচয়ের রক্ষাকবচ হতে পারে। এই যুগে প্রয়োজন এমন সাহিত্যচর্চা যা আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা বজায় রেখে আধুনিক বাস্তবতাকে গ্রহণ করে। কারণ সাহিত্য যদি হৃদয়ের ভাষা হয়, তবে সংস্কৃতি সেই হৃদয়ের ছন্দ। তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বলাই যায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি শুধু এক ও অবিচ্ছেদ্য নয়, বরং তারা একটি জাতির অস্তিত্বের মৌলিক শিকড়।
প্রবাসী লেখকের সাহিত্যেও সংস্কৃতির চিহ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে বাস করেও তাঁরা তাঁদের শিকড়, ঐতিহ্য ও জাতিগত পরিচয় খুঁজে ফেরেন সাহিত্যের মাধ্যমে। ঝরনা ধারা চৌধুরী, তাহমিনা আনাম বা ঝুম্পা লাহিড়ীর মতো প্রবাসী লেখকেরা তাঁদের লেখায় পশ্চিমা বাস্তবতার মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির টানাপোড়েনকে তুলে ধরেন। ঞযব ঘধসবংধশব উপন্যাসে ঝুম্পা লাহিড়ী দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবাসীদের পরিচয় সংকট ও সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি তুলে ধরেন যা অভিবাসী জীবনের বাস্তব চিত্র। এই সাহিত্যগুলো বৈশ্বিক পাঠকের কাছে একটি জাতির সংস্কৃতিকে তুলে ধরার সেতু তৈরি করে, এবং একই সঙ্গে বিশ্বায়নের যুগে ব্যক্তিগত সংস্কৃতি রক্ষার সংকটকেও উন্মোচন করে।
লোকসংস্কৃতি মূলত সাধারণ মানুষের জীবনের সৃজনশীল প্রকাশ। এই সংস্কৃতি সাহিত্যে প্রবাহিত হয়ে এসে কেবল রচনা নয়, জাতির ঐতিহাসিক স্মৃতির সংরক্ষক হিসেবেও কাজ করে। নকশিকাঁথার মাঠ (জসীমউদ্দীন) একটি কবিতা হলেও এতে গ্রামীণ নারীর জীবন তার বেদনা ও শিল্পচর্চার চমৎকার সাংস্কৃতিক রূপায়ণ রয়েছে। মৌলভীবাজারের পুথি সাহিত্য বা সিলেট অঞ্চলের গীতি সবই লোকসংস্কৃতিকে সাহিত্যের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছে। সাহিত্য যদি সমাজের চেতনাকে ধারণ করে, তাহলে লোকসাহিত্য হল সেই চেতনার প্রাণভাষা। ধর্মও একটি সাংস্কৃতিক কাঠামো এবং সাহিত্য বহু সময়েই ধর্মীয় মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান বা ধর্মীয় সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে ব্যাখ্যা করেছে। লালন ফকিরের গান আধ্যাত্মিকতা, মানবধর্ম, অসাম্প্রদায়িক ভাবনা এবং বাউল সংস্কৃতিকে সাহিত্যের স্তরে নিয়ে গেছে। রুমির কবিতা বা হাফিজের গজল এসব ইসলামী সংস্কৃতির গহীন দিক তুলে ধরেছে যা বিশ্বসাহিত্যে অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করে। এ ধরনের সাহিত্য মানুষের আত্মা ও সংস্কৃতির মধ্যকার সংযোগের প্রতিচ্ছবি। বর্তমান সময়ে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাহিত্যে সংস্কৃতির নতুন দিক উঠে এসেছে। যাকে বলা হয় ইকোলজিকাল লিটারেচার বা পরিবেশ-সাহিত্য। হেলেন কেনেডি, আরুন্ধতী রায় বা বাংলা সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের লেখায় পরিবেশ সংক্রান্ত সচেতনতা দেখা যায়। নদী, পাহাড়, বন এসব কেবল প্রাকৃতিক উপাদান নয় বরং একটি সংস্কৃতিরও অংশ। সাহিত্য সেই সংযোগকে সামনে আনে। প্রকৃতি-সংস্কৃতি-সাহিত্যের এই ত্রিভুজ সম্পর্ক সমকালীন সাহিত্যের একটি নতুন মাত্রা। ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং একটি সংস্কৃতির মৌলিক ভিত্তি। সাহিত্য সে ভাষাকে জীবন্ত রাখে এবং সংস্কৃতির বাহক হিসেবে কাজ করে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একদিকে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের সংগ্রাম, অপরদিকে সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত সাহিত্যে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে কবিতা, গল্প, নাটকে। সাহিত্য যদি মাতৃভাষায় রচিত না হয়, তবে একটি জাতির সংস্কৃতি ও চেতনা বিকশিত হতে পারে না। সাহিত্যিক ভাষার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির পরিবর্তনও ধরা পড়ে। বর্তমান যুগে সাহিত্য ও সংস্কৃতি নানা সংকটে নিমজ্জিত। তবে সংকটের মধ্যেই সম্ভাবনা নিহিত থাকে। জনপ্রিয়তাকেন্দ্রিক সাহিত্য (ঢ়ড়ঢ় ষরঃবৎধঃঁৎব) অনেক সময় গভীরতা হারাচ্ছে। টিভি, ওয়েব সিরিজ ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে সাহিত্যের পাঠক সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বাস্তবধর্মী সাহিত্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি যথাযথভাবে উঠে না আসার অভিযোগও রয়েছে। সাহিত্য আজ অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক। নারী, লিঙ্গ-সংখ্যালঘু, আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সাহিত্যচর্চায় সম্পৃক্ত হচ্ছেন। অনলাইন সাহিত্যের বিকাশ নতুন লেখকদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। সাহিত্য এখন আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে বৈচিত্র্যকে উদযাপন করছে। বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক সাফল্য একদিকে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে শক্তিশালী করেছে, অন্যদিকে বিশ্বের কাছে বাংলা সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করে। তাহমিনা আনাম, জয়া মিত্র, মোমিনুল আজহার মতো লেখকের ইংরেজিতে রচিত সাহিত্য বাংলা সংস্কৃতির বহির্বিশ্বে সেতুবন্ধ তৈরি করছে। সাহিত্যই সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে একটি জাতির সংস্কৃতি ভৌগোলিক সীমার বাইরে বিস্তৃত হতে পারে।
একটি জাতির অস্তিত্ব, আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্য নির্ভর করে তার সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর। সাহিত্য কেবল মুদ্রিত কিছু শব্দ নয়, বরং একটি সময়ের মনোভঙ্গি, সংস্কৃতির বহমানতা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। সংস্কৃতি কেবল রীতি-নীতি নয়, বরং তা জীবনের রং, ছন্দ ও দর্শন। এই দুইয়ের পারস্পরিক নির্ভরতা এবং শক্তিশালী বন্ধন মানবসভ্যতাকে করে তুলেছে সৃষ্টিশীল, সংবেদনশীল ও সচেতন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি এই দুই ধারাই আমাদের ইতিহাস, আত্মমর্যাদা ও মানবিক মূল্যবোধের বাহক। এদের বিকাশ ও সংরক্ষণ কেবল নীতিগত দায়িত্ব নয় বরং জাতিগত দায়িত্বও বটে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক, সমান্তরাল ও অবিচ্ছেদ্য। সাহিত্যই সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে, আর সংস্কৃতিই সাহিত্যের প্রাণ জোগায়। মানবজীবনের গভীরতম অনুভূতি, সংগ্রাম, স্বপ্ন ও বোধ এই দুইয়ের সমন্বয়ে ফুটে ওঠে। ভবিষ্যতের সমাজ ও প্রজন্মকে পথ দেখাতে হলে সাহিত্য-সংস্কৃতির এই বন্ধনকে আরও মজবুত করতে হবে—তবে শুধুই রক্ষণশীল নয়, বরং সৃজনশীলতা, উদারতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে। কারণ সাহিত্য-সংস্কৃতিই একটি জাতিকে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, অমর করে রাখতে পারে তার আত্মপরিচয়।
লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, প্রাবন্ধিক, চাঁদপুর।