• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

নির্বাচনকালীন সরকার কী করতে পারবে, কী পারবে না

প্রকাশ:  ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার। তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ সরকারের ক্ষমতা কমেছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার চাইলেও এখন বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বদলি করতে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি লাগবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার এখন মেজর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর যেগুলো পলিসি সংক্রান্ত যেমন আমাদের জনপ্রশাসন আছে, তারপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, জনপ্রশাসনের যে স্বাভাবিক কার্যক্রমগুলো হচ্ছে সেগুলো হবে। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে রেগুলার কাজগুলো হচ্ছে, সেগুলো তারা করবে। এই রেগুলার কাজ করার ক্ষেত্রে, জনপ্রশাসন চলার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যদি কিছু বলে সেটা তাদের ফলো করতে হবে। কারণ এখন জনপ্রশাসন হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের অধীনে।
সরকার এখন মেজর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর যেগুলো পলিসি সংক্রান্ত যেমন আমাদের জনপ্রশাসন আছে, তারপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, জনপ্রশাসনের যে স্বাভাবিক কার্যক্রমগুলো হচ্ছে সেগুলো হবে
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সরকারের যেসব প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোর বরাদ্দ আছে, যেগুলোর কাজ চলছে, সেগুলোর কাজ চলবে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকালীন নরমালি আমরা দেখেছি মন্ত্রিসভার বৈঠক হয় না, তবে যদি হয় সে ক্ষেত্রে কোনো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ‘প্রশাসন তো পুরো নির্বাচন কমিশনের অধীনে আছে এখন। প্রশাসন না শুধু, নির্বাচনী এলাকায় যে কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করতে নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন লাগবে।’
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এবং নির্বাচনী বিধিমালার আলোকে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি, পদায়নসহ কিছু কিছু কাজে সরকারকে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে সরকারের রুটিন কাজগুলো চালিয়ে নিতে নির্বাচন কমিশনের অনুমতির প্রয়োজন হবে না।
সরকারের রুটিন কাজ কী?
সরকারের রুটিন কাজগুলো কী? জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী আলাদাভাবে কিছু করার নেই।’
রুটিন কাজের ব্যাখ্যা দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘গতানুগতিক অফিস চলার ব্যাপারে, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বেতন পাওয়ার ব্যাপারে, প্রতিদিনকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে, এসব বিষয়ে অবশ্যই এ সরকার কাজ করবে। উন্নয়ন কাজ যেগুলো আছে, সেগুলো চলমান থাকবে।’
তবে নতুন করে কোনো উন্নয়ন কাজ শুরু হবে না এবং নতুন করে কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না বলেও জানান তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘একটি দলের পক্ষে যা কিছু নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে, এ রকম কাজ আমরা করবো না।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে, এরপরে নির্বাচনের কাজকর্ম নির্বাচন কমিশন দায়িত্বশীলভাবে করবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের কাজে যেসব সরকারি বিভাগ, সংস্থা বা অফিস তাদের প্রয়োজন হবে এবং নির্বাচন প্রভাবিত হবে না, সেইসব নির্বাচন কমিশন করবে। যে সরকার আছে, সেই সরকার গতানুগতিক রুটিন কাজগুলো করে যাবে। আর গণতন্ত্রে মূল বক্তব্য যখন নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এখন থেকে রুটিন কাজ করে যাবে।’
নির্বাচনকালীন সরকারের ইতিহাস
দেশ স্বাধীনের পর সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান ছিল। ১৯৯১ সালে এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের অধীনে ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। তিন মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে সব বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিনি এ অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বা ‘নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার’ সরকার ব্যবস্থা গঠন করেন। ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।
১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি আর মানুষের জীবিকা। প্রবল আন্দোলন এবং সহিংসতার মুখে ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর পঞ্চম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয় সাবেক ব্রিটিশ কলোনি দেশগুলোর জোট কমনওয়েলথ। সংস্থাটির তরফ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমঝোতার প্রয়াসের অংশ হিসেবে স্যার নিনিয়ান ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায়-দফায় বৈঠক করেন। তবে, সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। শেষ পর্যন্ত কোনো রকম সমাধান খুঁজে না পেয়ে ফিরে যান স্যার নিনিয়ান।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে বিতর্কিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের সময় শুধুমাত্র বিএনপির নেতারাই মন্ত্রিসভায় ছিলেন। সেই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি পেয়েছিল ২৮৯টি আসন। অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করে।
শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ৩ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পরামর্শে সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস। পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করে গঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন থেকেই স্থায়ী ভিত্তি পায় এ সরকার ব্যবস্থা।
ওই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
২০০১ ও ২০০৬ সালেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। এর মধ্যে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন লতিফুর রহমান। নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদের অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল
২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। ফলে এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ের ভিত্তিতে পঞ্চদশ সংশোধনী করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়। এ দুই নির্বাচন নিয়েও নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মোট ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়। বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করে। ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলো।

২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তবে, এ নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জোটসঙ্গীরা ২৮৮টি আসন পায়। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র সাতটি। বাকি তিনটি আসন পায় অন্যরা। সূত্র : ঢাকা পোস্ট।