• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫, ৪ ভাদ্র ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

বিদেশি বাংলাদেশি মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নেপথ্যে কী?

প্রকাশ:  ১৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:২৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চলতি মাসে অন্তর্বর্তী সরকার বছর পূর্ণ করেছে। এ সময়ে রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের থাকা না-থাকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। আচমকা বিদেশে বাংলাদেশি মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর এটি করা হয়েছে টেলিফোন নির্দেশনায়। বছর ব্যবধানে কেন রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর প্রসঙ্গ আসছে, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে এর কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় সামনে আসছে। তবে এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়ে প্রাধান্য দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র। সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টার বিদেশ সফরে গিয়ে একটি মিশনে রাষ্ট্রপতির ছবি টাঙানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিদ্ধান্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিদেশে বাংলাদেশের যেসব মিশনে এখনো রাষ্ট্রপতির ছবি টাঙানো আছে, সেগুলো সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব মিশনকে নির্দেশ না দিয়ে কয়েকজন দূতকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের বলা হয়েছে অন্য মিশনপ্রধানদের জানিয়ে দেওয়ার জন্য। গত শনিবার মধ্য রাত থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নির্দেশনার খবর প্রকাশিত হয়। রোববার (১৮ আগস্ট) পুরোদিন এটি ছিল টক অব দ্যা কান্ট্রি। তবে সরকারের তরফ থেকে বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আসেনি। 
এদিন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা-বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের এক বৈঠক ছিল। কয়েক ঘণ্টার বৈঠকটি বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ শেষ হয়। বৈঠক থেকে বেরোতে রাষ্ট্রপতির ছবি ইস্যুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়াম। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। এমনকি, মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাহ আসিফ রহমানও প্রশ্ন এড়িয়ে যান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমিও আপনার মত পত্রিকায় পড়েছি, কিন্তু যেহেতু আমি বিদেশি দূতাবাসে কাজ করি না, সেহেতু বলতে পারছি না যে আসলে প্রেক্ষিতটা কী।’
সরকারি সিদ্ধান্ত হলে তার লিখিত কাগজপত্র থাকত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদে এ বিষয়ে আলোচনা হলে বলা যাবে।’
এক প্রশ্নে রিজওয়ানা বলেন, ‘এটার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা স্পষ্ট। একটা ছবির সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক থাকতে পারে না।’ সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ৮২টি মিশন ও উপমিশন রয়েছে। এরমধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পরপরই অনেক মিশন থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। নতুন নির্দেশনার আগ পর্যন্ত প্রায় ৭০টি মিশন বিগত সময়ের সব ছবি সরিয়ে ফেলে। নতুন করে রাষ্ট্রপতির ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশনার পর এরই মধ্যে বাকি মিশনগুলো থেকেও রাষ্ট্রপতির ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ইউরোপের একটি মিশনে পদায়নরত এক কূটনীতিক জানান, এ মিশনে রাষ্ট্রপতির ছবি ছিল। নতুন নির্দেশনা পাওয়ার পর শনিবার বিকেলে মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানো হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের চার অনুচ্ছেদে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহারের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এর বাইরে সরকার প্রধানের ছবি ব্যবহার করা নিয়ে কোনো আইন, বিধি বা সাংবিধানিক নির্দেশনা বিগত সরকারের সময়ে হয়নি। তবে, ২০০২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রীদের কার্যালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি কিংবা ছবি টাঙানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই নির্দেশ মোতাবেক বিদেশে বাংলাদেশি মিশনে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের ছবি টাঙানো রীতি চলে আসছে। তবে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছবি টাঙানোর বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেননি। বরং পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন বা অন্য কোনো প্রচারণায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
সাবেক এক রাষ্ট্রদূত বলেন, রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সরকারি আদেশে রাষ্ট্রপতির ছবি ব্যবহারের নির্দেশনা ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিশনগুলোতে অফিশিয়াল পোর্ট্রেট সরবরাহ করতো। আর এই পোট্রেট কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন করে দেওয়া হতো। মিশন বলে কথা না সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোর জন্য একই ছবি নির্বাচন করা হতো। কেউ চাইলেও রেনডমলি ছবি নির্বাচনের সুযোগ ছিল না। হঠাৎ করে শুধু মিশন থেকে ছবি সরানোর নির্দেশনা হবে, এমনটা হওয়ার কথা না। হলে সরকারি অন্য অফিসেও একই নির্দেশনা হওয়ার কথা।
রোববার রাতে প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘সরকারি দপ্তরে পোট্রেট ব্যবহার শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নিরুৎসাহিত করছে। অলিখিতভাবে জিরো পোট্রেট নীতি বজায় রেখেছে। তারপরও কেউ কেউ সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি নিজ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করেছে। সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে এমন কোনো লিখিত নির্দেশনা কোনো দপ্তর কিংবা মিশনকে দেওয়া হয়নি। তারপরও দেখা যাচ্ছে আজ এটা নিয়ে বাজার গরম করে ফেলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় ঘোষণা করার পর রাজনীতি নিয়ে ঘোঁট পাকানোর সুযোগ কমে আসছে। কাটতি ধরে রাখার জন্য ছোট খাটো অনেক বিষয়কেও এখন তাই পাহাড়সম করে তোলা হচ্ছে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রপতির ছবি রাখা না রাখা পুরোপুরি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয় না। নতুন কোনো নিয়ম হয়েছে কিনা-আমার জানা নেই, তবে মন্ত্রিপরিষদের আগের সিদ্ধান্ত ছিল যে কোনো সরকারি অফিসে রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধানের ছবি টাঙাতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা না পেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের নির্দেশনা দিতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নে মাহফুজুর রহমান বলেন, বলে না থাকলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বলার কথা না। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত মৌখিক নির্দেশ কেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়। 

সর্বাধিক পঠিত