• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

ঐক্যফ্রন্ট কি ভেঙে যাচ্ছে?

প্রকাশ:  ২৮ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:১৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণের পর শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট টিকবে কিনা- তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতিতে বেশ চাপে আছে বিএনপি।সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তিন এমপির সংসদে যাওয়া ও বাকি চারজনের আজ-কালের মধ্যে শপথ নেয়ার গুঞ্জন, জামায়াতের ভাঙন এবং গণফোরামের কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে অস্থিরতার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এই বাড়তি চাপ।এতে বিরোধী দুই জোট (২০ দল ও ঐক্যফ্রন্ট) নিয়ে বিএনপি একরকম অস্বস্তিতে পড়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে গণফোরামে।তাদের মতে, নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সামনে রেখে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু রাজনৈতিক কৌশলের কাছে তা অনেকটাই ব্যর্থ হতে চলেছে।

বিশেষ করে ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন তারা। নির্বাচনে বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত রাখা এবং গণফোরামের দুই এমপির শপথ নেয়ার ক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেনের বিশেষ ভূমিকা ছিল কিনা- তা নিয়েও সন্দেহ আছে অনেকের।তার ভূমিকায় শুধু বিএনপি নয়, গণফোরামের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতা। শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট টিকবে কিনা- তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে বিএনপি কিছুটা বিব্রত। গণফোরামের দুই প্রার্থীর শপথের পর বিএনপির একজনও শপথ নিয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেয়ায় বিরোধী শিবিরে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে।

জামায়াত প্রসঙ্গে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আর সম্পর্ক রাখা উচিত নয়। দলটি ভেঙে যাচ্ছে। তাই বিএনপির উচিত হবে স্বাধীনতাবিরোধী এ দলটির সঙ্গ ত্যাগ করা। কারণ জামায়াতের কারণে দলটিকে দেশে-বিদেশে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়েছে।তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দল অস্বস্তিতে রয়েছে তা মানতে নারাজ বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করেন, শপথ নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের চাপ রয়েছে। যদিও সরকার তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম দাবি করেন, শপথ নেয়ার ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে নিঃসন্দেহে চাপ রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতে, বিএনপি হল একটা বড় বটগাছ। এখান থেকে দু-একটা পাতা ঝরে গেলে কিছু যায় আসে না।দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা অনেকটা বিব্রত ও অস্বস্তিতে রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে নড়েচড়ে বসেছেন দলটির হাইকমান্ড।এক এমপি শপথ নেয়ার পরপরই বাকিদের সঙ্গে কথা বলেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা।

বাকিরা যাতে শপথ না নেন সে ব্যাপারে নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। শনিবার রাতে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় চূড়ান্তে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।তবে দলের একটি সূত্র জানায়, হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত বা অনুরোধ উপেক্ষা করেও আরও কয়েকজন শপথ নিতে পারেন।একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র আটটি আসনে জয়লাভ করে। গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দু’জন এমপি- মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া-কমলগঞ্জ) আসনের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও সিলেট-২ আসনের মোকাব্বির খান ইতিমধ্যে শপথ নিয়েছেন।অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে গণফোরামের শীর্ষ নেতাদের ইন্ধন রয়েছে। গণফোরামের শীর্ষ নেতাদের কর্মকাণ্ডে তাই মনে হচ্ছে।ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে বিএনপির অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে নির্বাচনের আগের দিন ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠলেও ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা হয়ে তিনি এর প্রতিবাদে কোনো উদ্যোগই নেননি।উল্টো নির্বাচনের দিন নিজের ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এখন পর্যন্ত ভোট মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচনে যাওয়া, শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে নির্বাচনে রাখা এবং গণফোরামের দুই এমপির শপথের বিষয়টি একই সূত্রে গাঁথা বলেও তারা মনে করেন।

বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের অনেক নেতার অভিযোগ, শপথ নেয়ার পর সুলতান মনসুরকে বহিষ্কার করেই দায়িত্ব শেষ করে গণফোরাম। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে স্পিকার বা নির্বাচন কমিশনে কোনো চিঠি দেয়া হয়নি।মনসুরকে লোক দেখানো বহিষ্কার করা হলেও মোকাব্বিরের ক্ষেত্রে সেটাও করা হয়নি। শপথ নেয়ার পর শোকজ করেই দায়িত্ব শেষ করেন গণফোরামের নেতারা।ড. কামাল হোসেনের পরামর্শে শপথ নিয়েছি- মোকাব্বির এমন দাবি করলেও গণফোরাম সভাপতি তা কখনও প্রতিবাদ করেননি। শপথ নেয়ার ক্ষেত্রে ড. কামালের মৌন সম্মতি ছিল তা অনেকটা খোলাসা হয়ে যায় শুক্রবারের কাউন্সিলে।চেম্বারে যাওয়ার পর ‘গেট আউট’ বলে মোকাব্বিরকে বের করে দিলেও কাউন্সিলে তিনি কিভাবে আসার সাহস পান সেই প্রশ্নই সবার মাঝে।তাও সভায় কামাল হোসেনের তিন আসন পরেই বসেন। তার ‘সবুজ সংকেত’ ছাড়া মোকাব্বির কাউন্সিলে আসার সাহস পায়নি বলে মনে করছেন তারা।কাউন্সিলের মঞ্চে মোকাব্বিরকে দেখেই গণফোরামের নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য ও মন্তব্য করেননি। মোকাব্বিরের উপস্থিতি নিয়ে কোনো কথা বলেননি।

ড. কামাল হোসেনের নীরবতায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, তা আঁচ করতে পেরে কাউন্সিলে অনুপস্থিত ছিলেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু।মোকব্বিরের উপস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তিনি যুগান্তরের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান। তিনি বলেন, সার্বিক কর্মকাণ্ডে আমাদের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে।মোকাব্বির খানের কর্মকাণ্ডে আমাদের বেশির ভাগ সদস্যই ক্ষুব্ধ। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করার পর উনি কিভাবে কাউন্সিলে আসেন তা বুঝতে পারছি না।মোস্তফা মোহসীন আরও বলেন, মোকাব্বিরকে মঞ্চে দেখে নেতাকর্মীরা যখন সেম সেম বলেন তখন বিব্রত হওয়া ছাড়া উপায় কি। এজন্য আমরা দুঃখিত, লজ্জিত।জাতির কাছে ক্ষমা চাইছি। ঐক্যফ্রন্টের মাধ্যমে আমরা জাতিকে একটা আশা দেখিয়েছিলাম, কিন্তু সেখান থেকে আমরা সরে যাচ্ছি।এদিকে কাউন্সিল চলাকালীন সভাস্থলের বাইরে এসে দল ছাড়ার ঘোষণা দেন গণফোরামের প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিক।তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এরকম দ্বৈত অবস্থান যেখানে থাকে, সেখানে তো রাজনীতি করা যায় না।মোকাব্বির প্রশ্নে তিনি (ড. কামাল) কোনো পরিষ্কার বক্তব্য দিচ্ছেন না। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খান ড. কামালের সাহস পেয়েই সংসদে গিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

গণফোরামের অস্থিরতার মধ্যেই শুরু হয়েছে জামায়াতের ভাঙন। শনিবার ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে সংস্কারপন্থীরা ‘জন-আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ’ নামে নতুন একটি প্ল্যাটফরম ঘোষণা করেন।জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য (সদ্যবহিষ্কৃত) মজিবুর রহমান মঞ্জু এ ঘোষণা দেন। তিনি এক সময় ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। মঞ্জুর নতুন দল ঘোষণাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন অনেকে।এর মধ্যে জামায়াতের এক সময়ের শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সমর্থন রয়েছে বলে গুঞ্জন আছে।গতকালের অনুষ্ঠানে রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তাজুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। সংস্কারপন্থীদের এমন ভূমিকায় জামায়াতের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তি।স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে জোট করে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনার মুখে বিএনপি। দলটির সঙ্গ ছাড়তে দেশি এবং বিদেশি শক্তি দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপিকে চাপের মুখে রেখেছে। কিন্তু কৌশলগত কারণে চাপের মধ্যেও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছেন তারা।এ নিয়ে প্রতিনিয়তই নানা মহলের প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। জোটের অন্যতম শরিকের ভাঙন নিয়েও অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি।জামায়াতের এসব কর্মকাণ্ড পুরো জোটের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। জামায়াত ছাড়াও জোটের অন্য শরিকদের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ছে বিএনপির। শরিকদের অবমূল্যায়ন, ঐক্যফ্রন্টকে গুরুত্ব দেয়াসহ নানা ইস্যুতে এই দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। যুগান্তর

 

সর্বাধিক পঠিত