• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
  • ||
  • আর্কাইভ

শবেবরাত : সহিহ হাদিস কী বলে?

প্রকাশ:  ০৭ মার্চ ২০২৩, ১৮:৪৭
মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম
প্রিন্ট

শবেবরাত ফারসি শব্দ। অর্থ মুক্তির রজনি। কোরআন কিংবা হাদিসে এ শবেবরাত শব্দটি হুবহু নেই। কিন্তু হাদিসে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান তথা শাবান মাসের মধ্য রজনি পরিভাষা রয়েছে। এ পরিভাষারই বাংলা সংস্করণ হলো শবেবরাত। কেউ কেউ এ রাতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে থাকেন। আবার যেহেতু সরাসরি এ শব্দটি কোরআন-হাদিসে নেই, তাই কেউ কেউ শবেবরাতকে বিদয়াত বলে থাকেন। মূলত এ ধারণাটি তাদের অজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যেরই পরিচায়ক। কারণ এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি করা নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। রাসুল সা. ও সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ থেকে অদ্যাবধি এ রাতে বিশেষভাবে নফল ইবাদত ধারাবাহিকতার সাথে চলে আসছে। আরবিতে আমাদের দেশে প্রচলিত নামাজ রোজা শব্দও নেই। এ শব্দগুলো ফার্সি হওয়ায় কোরআন-হাদিসে না-থাকাটাই স্বাভাবিক। যেমন খোদা, ফেরেশতা, বেহেশত, দোজখ, পয়গম্বর, গুনাহ প্রভৃতি শব্দও কোরআন-হাদিসে নেই। কিন্তু বাংলাভাষায় সুদীর্ঘকাল থেকেই শব্দগুলো ধর্মীয় পরিভাষা হিসেবে চলে আসছে। কেউ কি বলে যে, এগুলো শরিয়তের অংশ নয়? তেমনই শবেবরাত আরবি ভাষায় নেই। তবে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শাবানের মধ্যরাত আরবিতে হাদিসে বর্ণিত আছে। যার অর্থ শবেবরাত।ইদানীং এক শ্রেণির লোক- যাদের কোরআন-হাদিসের আবশ্যিক কোনো জ্ঞান নেই, তারা নিজেদের অতি গবেষণার মাধ্যমে ইসলামের সুপ্রমাণিত বিষয়গুলোকে জনসাধারণের মাঝে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। তারা বলছে, শবেবরাতের হাদিসগুলো সহিহ নয়; এ রাতে ইবাদত করা বিদয়াত ইত্যাদি। অথচ লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান তথা শবেবরাত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার পরও বিদয়াত বলাটা হাদিস সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। মজার ব্যাপার হলো, কোরআন-হাদিসের আবশ্যিক জ্ঞানবিহীন এ লোকগুলোর তাকলিদপ্রণেতা নাসির উদ্দিন আলবানি, ইবনে তাইমিয়া ও আবদুল্লাহ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরও শবেবরাতের হাদিসগুলোকে সহিহ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মূলত জেনেশুনে অকাট্য বিষয়কে বিদয়াত কিংবা শরিয়ত বহির্ভূত বলাটা রাসুল সা.-এর হাদিস অস্বীকারেরই নামান্তর। এমন ব্যক্তি নিঃসন্দেহে মারাত্মক অপরাধে অপরাধী। রাসুল সা.-এর হাদিসের প্রতি বিদ্বেষী হওয়া ছাড়া হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এ ফজিলতপূর্ণ রাতকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

নিম্নে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো :

১. হজরত আলী বিন আবু তালিব রা. থেকে বর্ণিত। রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে [শবেবরাত] তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়, আর দিনের বেলা রোজা রাখ। নিশ্চয় আল্লাহ এ রাতে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন- কোনো গোনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমার কাছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কোনো রিজিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দিব। কোনো বিপদগ্রস্ত মুক্তি পেতে চায় কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব। আছে কি এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত। (সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৮৮, শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ৩৮২২)

২. হজরত আয়েশা রা. বলেন, এক রাতে রাসুল সা.-কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে [মদিনার কবরস্থান] গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার আয়েশা? [তুমি যে তালাশে বের হলে?] তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল তোমার উপর কোনো অবিচার করবেন? [তোমার পাওনা রাতে অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়ে রাত্রিযাপন করবেন?] হজরত আয়েশা রা. বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসুল সা. তখন বললেন, যখন শাবান মাসের মধ্য রজনী (শবেবরাত) আসে, তখন আল্লাহ তায়ালা এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (জামাত তিরমিজি, হাদিস নং ৭৩৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ২৬০২৮, মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ, হাদিস নং ১৫০৯)

৩. হজরত মুয়াজ বিন জাবাল রা. থেকে বর্ণিত। রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, অর্ধ শাবানের রাতে [শবেবরাতে] আল্লাহ তায়ালা তাঁর সমস্ত মাখলুকের প্রতি মনোযোগ আরোপ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৯০, সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৫৬৬৫, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদিস নং ২৭৫৪, মুসনাদে ইসহাক বিন রাহওয়াই, হাদিস নং ১৭০২, আল মুজামুল আওসাত, হাদিস নং ৬৭৭৬, আল মুজামুল কাবীর, হাদিস নং ২১৫, মুসনাদুশ শামীন, হাদিস নং ২০৩, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস নং ৩০৪৭৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ৬২০৪)লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান তথা শবেবরাতকে অস্বীকারকারী গায়রে মুকাল্লিদদের ইমাম শায়েখ আলবানি রহ. তার সিলসিলাতুস সাহিহা’র তৃতীয় খণ্ডের ১৩৫নং পৃষ্ঠায় বলেন, ‘এই হাদিসটি সহিহ।’ এটি সাহাবিদের এক জামাত বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সূত্রে। যার একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করেছে। তাদের মাঝে রয়েছেন- হজরত আবু বকর রা., আবু হোরায়রা রা., মুয়াজ বিন জাবাল রা., আবু সা’লাবা রা., আব্দুল্লাহ বিন আমর রা., আবু মুসা আশয়ারী রা., আউফ বিন মালিক রা., আয়েশা রা. প্রমুখ সাহাবিগণ। উপরে বর্ণিত সবক’টি বর্ণনাকারীর হাদিস আলবানী রহ. কিতাবে আনার মাধ্যমে সুদীর্ঘ আলোচনার পর পরিশেষে তিনি বলেছেন- =সারকথা এই যে, নিশ্চয় এই হাদিসটি এ সকল সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহিহ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর সহিহ হওয়া এর থেকে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়, যতক্ষণ না মারাত্মক কোনো দুর্বলতামুক্ত থাকে। যেমন এই হাদিসটি হয়েছে। গায়রে মুকাল্লিদদের আরেক ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. তাঁর কিতাবে লিখেছেন- অতীত যুগের বড় আলেম ও শায়েখরা শবেবরাতে বেশি ইবাদত বন্দেগি করতেন। তাই এ রাতে ইবাদত করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা শরিয়ত বিরোধী নয়। তবে হ্যাঁ, আমাদের দেশে শবেবরাতকে কেন্দ্র করে যে হালুয়া-রুটি, আতশবাজির রুসুম রেওয়াজ রয়েছে তা নিঃসন্দেহে কুসংস্কার।

লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন। ০১৭১১ ৩৩৩৯৯৬

সর্বাধিক পঠিত